ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড বিসনেস ইমপ্যাক্ট

পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রনিক যান: সবুজ পৃথিবীর সূচনা

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনও প্রকট আকার ধারণ করেছে। মরুভূমিতে বন্যা, অতিবৃষ্টিতে দুবাইয়ে পানিবন্ধী হওয়ার ঘটনা কিংবা বাংলাদেশে প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়, খরাসহ নানা দূযোর্গের সংবাদ আমাদেরকে বারবার পরিবেশের দুরাবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া। আর এই সমস্যার সমাধানে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ইলেকট্রনিক যান বা পরিবেশ-বান্ধব যান। আজকে আমরা এই পরিবেশ-বান্ধব যান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

পরিবেশবান্ধব  ইলেকট্রনিক যান

একটি পরিবেশ-বান্ধব ইলেকট্রনিক যান বলতে এমন যানবাহনকে বোঝানো হয় যা পরিবেশের উপর কোনো প্রকার বিরুপ প্রভাব ফেলে না। এই যানের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি এবং প্রযুক্তি দ্বারা চালিত যানবাহন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিক যানবাহন, হাইব্রিড যানবাহন, হাইড্রোজেন যানবাহন, পরিষ্কার ইথানল যান, প্রাকৃতিক গ্যাসের যানবাহন, পরিষ্কার ডিজেল যান ইত্যাদি। অর্থাৎ,ইলেকট্রনিক যানবাহন বলতে এমন ধরনের যানবাহনকে বোঝানো হয় যা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প শক্তির উৎসের উপর নির্ভরশীল বা পেট্রোল, ডিজেলের তুলনায় কম কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গমন করে।

ইলেকট্রনিক যানবাহনের সুবিধা

বিশ্বব্যাপী সবুজ যানবাহনের বিপ্লব চলছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো পেট্রোল-ডিজেল চালিত যানবাহন থেকে এখন এই যানবাহনের দিকে ঝুঁকছে। তারা নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করছে। কারণ, ইলেকট্রনিক যান পরিবেশের জন্য বেশ উপকারী। চলুন সবুজ যান ব্যবহারের নানা সুবিধা সম্পর্কে জেনে নেই।

ইলেকট্রনিক যান: শক্তি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং দূষণ কমানোর জন্য উপকারী যানবাহন।

ইলেকট্রনিক যানবাহন চার্জ করা হচ্ছে: শক্তি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব যানচালনা। | ছবি সংগৃহীত।

পরিবেশ-বান্ধব

বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি)পরিবেশের জন্য বেশ উপকারী। বিশেষ করে পেট্রোল যানবাহনের তুলনায় এরা পরিবেশ-বান্ধব। পেট্রোল যানবাহন প্রায় ৪১% কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। সাধারণ যানবাহনের ইঞ্জিনগুলো  উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং সালফার অক্সাইড এর মতো দূষকগুলো নির্গত করে, যা মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য অনেক বিপজ্জনক। বৈদ্যুতিক যানবাহন এধরনের দূষক নির্গমন করে না।

সাশ্রয়ী

বৈদ্যুতিক যানবাহন বেশ কম ব্যয়বহুল জ্বালানী। এমনকি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বিদ্যুতের উচ্চদাম সম্পন্ন রাজ্যগুলোতে, যেখানে এক কিলোওয়াট-ঘণ্টা  বিদ্যুতের গড় খরচ ২১ সেন্টের বেশি, সেখানে আপনি গ্যাস পাম্পে জ্বালানি খরচের অর্ধেকেরও কম খরচে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে পারবেন ৷ কম বিদ্যুতের দামসম্পন্ন রাজ্যগুলোতে , দেশে বা আপনি যদি ঘরে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ করেন (যেমন, সৌর) খরচ আরো কম হবে।

দ্রুত গতিসম্পন্ন

ইভির তুলনায় গ্যাস-চালিত যানবাহন ধীরগতিতে চলে। ইভি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাদের সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছাতে পারে কারণ তাদের মোটরগুলো অনেক সহজ ইঞ্জিনের জন্য সম্পূর্ণ টর্ক পেতে পারে। অনেক ইভি মডেল মসৃণ হ্যান্ডলিংও অফার করে, যা আরামদায়ক যাত্রার জন্য তৈরি।

ইলেকট্রনিক যান কি আসলেই পরিবেশ-বান্ধব?

সাধারণ যানবাহন পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। এই যানবাহনগুলো থেকে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বায়ু দূষক এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয় যা প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে৷ অন্যদিকে, বৈদ্যুতিক গাড়িগুলো গ্যাস চালিত গাড়ির তুলনায় পরিবেশের জন্য প্রায় ৫০% ভালো কারণ তারা কম দূষক  উৎপাদন করে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে ১০০% পরিচ্ছন্ন শক্তি বা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন ফটোভোলটাইক সিস্টেমের সাথে একীকরণ। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন ক্লিন ট্রান্সপোর্টেশন (আইসিসিটি)-এর মতে, “ব্যাটারি-ইলেকট্রিক যানগুলো এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন করে।”

পরিবহন খাত বিশ্বের বেশিরভাগ পেট্রোলিয়াম পোড়ায় এবং এটি বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের বৃহত্তম উৎসের মধ্যে একটি। গাড়িগুলো বায়ু দূষণের একটি প্রধান কারণ যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং কণা পদার্থ তৈরি করে। শুধু তাই নয়, গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমেরিকার সবচেয়ে বড় বায়ু দূষণের কারণ হলো যানবাহন। সমস্ত মার্কিন বায়ু দূষণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উৎপন্ন করে এই যানবাহন ৷ 

ওয়ার্ল্ড কাউন্টস থেকে পাওয়া তথ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ পর্যন্ত অকালমৃত্যুর জন্য বাতাসের দূষককণা পদার্থই দায়ী।

ইলেকট্রনিক যান: পরিবেশবান্ধব কি না, তা নিয়ে আলোচনা করার একটি ছবি, যেখানে একটি ইলেকট্রনিক যান দেখানো হচ্ছে।

ইলেকট্রনিক যান: পরিবেশবান্ধব ধারণা, যেখানে একটি গাড়িকে সবুজ ঘাস দিয়ে সাজানো হয়েছে। | ছবি সংগৃহীত।

বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) শূন্য টেলপাইপ নির্গমন  করে, যার অর্থ তারা বায়ুমন্ডলে সরাসরি কার্বন-ডাইঅক্সাইড বা অন্যান্য ক্ষতিকারক দূষক নির্গত করে না। এটি আমাদের কার্বন পদচিহ্ন হ্রাস করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে গভীর প্রভাব ফেলে। আর তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জাপান ২০৪০ সালের মধ্যে প্রচলিত যানবাহনগুলোকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার পথে রয়েছে ৷ আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) মতে, ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পরিবহন দ্বিগুণ হবে এবং গাড়ির মালিকানা ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে ৷

উপরন্তু, বৈদ্যুতিক যানবাহন বায়ুর গুণমান উন্নত করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে শহুরে এলাকায় যেখানে বায়ু দূষণ একটি স্থায়ী সমস্যা। দ্য ইউনিয়ন অফ কনসার্নড সায়েন্টিস্টস রিপোর্ট করেছে যে, আইসিই যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ধোঁয়াশা তৈরিতে এবং ক্ষতিকারক কণা পদার্থে অবদান রাখে, যা শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ সহ গুরুতর স্বাস্থ্যগত প্রভাব ফেলে। বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহার করে আমরা এই ক্ষতিকার নির্গমনগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারি এবং সবার জন্য পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করতে পারি।

ইলেকট্রনিক যান এবং বাংলাদেশ

জাতিসংঘ পরিবেশ প্রোগ্রামের একটি সমীক্ষায় গণনা করেছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০% ব্যাটারি-ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল বিক্রিতে বৈশ্বিক পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১১ বিলিয়ন টন CO2 নির্গমন হ্রাস পেতে পারে।

ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে, যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি, সেখানে হাইব্রিড গাড়ি ক্ষতিকর দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে । বাংলাদেশের বাজারে হাইব্রিড গাড়ির একটি বড় সুবিধা হল সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক প্রণোদনা। এই প্রণোদনাগুলোর মধ্যে ট্যাক্স বিরতি এবং ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা ভোক্তাদের জন্য হাইব্রিড গাড়িগুলোকে আরও সাশ্রয়ী করে তোলে ৷ হাইব্রিড গাড়ি ক্রয়ের উপর কর কমিয়ে সরকার পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প বেছে নিতে জনগণকে উৎসাহিত করছে।

ইলেকট্রনিক যান বাংলাদেশে: পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই যানবাহন ব্যবহারের প্রসার।

ইলেকট্রনিক যান এবং বাংলাদেশ: পরিবেশবান্ধব যানবাহনের ভবিষ্যত। | ছবি সংগৃহীত।

সরকার একটি নীতি ঘোষণা করেছে যার লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে রাস্তায় সমস্ত যানবাহনের কমপক্ষে ১৫% বিদ্যুতে চলবে এবং সম্প্রতি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি দেশে ইভিগুলির সঠিক পরিচালনা এবং নিবন্ধনের জন্য একটি নির্দেশিকা চূড়ান্ত করেছে। এই উদ্যোগগুলি একটি টেকসই পরিবহন খাতের জন্য একটি শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, অবকাঠামোগত ঘাটতি পূরণ করা , সর্বোত্তম অনুশীলন এবং জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে সহযোগিতা অপরিহার্য।

বৈদ্যুতিক যানবাহন কম দূষক পদার্থ নির্গমন এবং বায়ুর গুণমান উন্নত করা সহ উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত সুবিধা প্রদান করে। বাংলাদেশে পুরোপুরি ইভি অবকাঠামো তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। আমাদের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এই সীমাবদ্ধতাগুলো মোকাবেলা করার জন্য সরকারি উদ্যোগ, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান জড়িত একটি সম্মিলিত সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।

“তথ্যসূত্র”

ট্যাবলেট সাবান : টেকসই পরিচ্ছন্নতার পরিবেশবান্ধব সমাধান

Previous article

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *