Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার |
আমরা প্রায়ই ‘বিশ্বব্যাপী শীর্ষ প্রভাবশালী নারী’ এমন শব্দ শুনে থাকি। কিন্তু আমরা কি জানি কারা এই তালিকা প্রকাশ করেন এবং কিভাবে তারা এই প্রভাবশালীর মানদণ্ড নির্ণয় করেন? প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ১০০ জন প্রভাবশালী এবং অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর নাম প্রকাশ করে থাকেন ‘বিবিসি ১০০ নারী’ নামক সিরিজ। ২০১৩ সাল থেকে তারা এই সিরিজ চালু করেছেন। পাঁচটি বিভাগে ১০০ জন নারীকে বেছে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে বিবিসি ১০০ নারী, ২০২৪ -এর তালিকা। আজকের আর্টিকেলে আমরা এমন ১১ জন নারী সম্পর্কে আলোচনা করবো যারা জলবায়ু নিয়ে কাজ করে বিবিসির প্রকাশিত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। চলুন সংক্ষেপে তাদের অবদান সম্পর্কে জেনে নেই।
১. সাশা লুকিওনি, কানাডা
-কম্পিউটার বিজ্ঞানী
ডিজিটাল এই যুগে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) কল্যাণে যে দ্রুতবেগের পরিবর্তন ঘটছে, তার ফলে অনেক সময়ই কার্বন ফুটপ্রিন্টের বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে যায়। সাশা লুকিওনি এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করেছেন যার সাহায্যে ডেভেলপাররা তাদের কার্বন নি:সরণের পরিমাণ পরিমাপ করতে পারবেন। এরই মধ্যে এই প্রযুক্তিটি ১৩ লক্ষবারেরও বেশি ডাউনলোড করা হয়েছে। তিনি মূলত ওপেন সোর্স এআই মডেল নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘হাগিন্স ফেস’ এর জলবায়ু বিষয়ক প্রধান। বর্তমানে তিনি একটি ‘এনার্জি স্টার রেটিং সিস্টেম’ তৈরি করার চেষ্টা করছেন যা জলবায়ুতে এআই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুেলোর প্রভাব পরিমাপ করতে সাহায্য করবে।
২. রোজমারি উইডলার-ওয়াল্টি, সুইজারল্যান্ড
-শিক্ষক এবং জলবায়ু কর্মী
ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে প্রথম জলবায়ু মামলায় জয়ী হন রোজমারি উইডলার-ওয়াল্টি। তিনি মূলত ‘ক্লাইমাসিনিয়রিনেন’ বা ‘সিনিয়র উইমেন ফর ক্লাইমেট প্রোটেকশন’-এর সহ-সভাপতি হিসেবে সুইস সরকারের বিরুদ্ধে নয় বছরের আইনি লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন। শুধু তাই নয়, তিনি অন্যান্য দুই হাজার নারীর সঙ্গে মিলে যুক্তি দেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় সুইস সরকারের অবস্থান তাদের স্বাস্থ্য অধিকারের ক্ষতি করেছে, এবং তাদের বয়স ও লিঙ্গ তাদের অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। গত এপ্রিল মাসে দেশটির আদালত ঘোষণা করে যে সুইস সরকারের নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা ছিল অপ্রতুল। যদিও সুইস সংসদ এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন, তবে এই মামলা জলবায়ু সংক্রান্ত আইনি পদক্ষেপের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
৩. ইনা মোজা, মালি
-শিল্পী এবং জলবায়ু কর্মী
ইনা মোজা, একজন জলবায়ু বিষয়ক আইনজীবী, সঙ্গীতশিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতানারী, যিনি নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতি প্রতিরোধ থেকে শুরু করে টেকসই উন্নয়ন প্রচারের কাজ করেছেন এবং বহু ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। ‘দ্য গ্রেট গ্রিন ওয়াল’ ডকুমেন্টারিতে তিনি একইসাথে প্রযোজনা ও অভিনয় করেছেন। এই ডকুমেন্টারিটি আফ্রিকার মরুভূমি বেড়ে যাওয়া রোধ এবং সাহেল অঞ্চলের নষ্ট হতে থাকা ভূমি পুনরুদ্ধারের উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টাকে নিয়ে করা হয়েছে। সাহেল অঞ্চল সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত। তিনি জাতিসংঘের কনভেনশন টু কমব্যাট ডেজার্টিফিকেশন-এর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরেন।
৪. সিলসিলা আচার্য, নেপাল
-টেকসই পরিবেশ উদ্যোক্তা
সিলসিলা আচার্য নেপালের বৃহত্তম প্লাস্টিক রিসাইক্লিং নেটওয়ার্কগুলোর একটি ‘আভনি ভেঞ্চারস’ পরিচালনা করেন। তিনি তার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবসায় প্রান্তিক সম্প্রদায় থেকে বিশেষ করে নারীদের নিয়োগ করেন যাতে তারা সবুজ খাতে আরো বেশি অংশগ্রহণ করে। ‘না ধন্যবাদ, আমি আমার নিজের ব্যাগ বহন করি’- ২০১৪ সালের এমন প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি যা প্লাস্টিক শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধে ভূমিকা রেখেছিল। এছাড়াও তিনি একটি বার্ষিক হিমালয় পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কাজ করেন, যেখানে পর্বতারোহীদের ফেলে যাওয়া আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়।
৫. মাহেদার হাইলেসেলাসি, ইথিওপিয়া
-ফটোগ্রাফার
ইথিওপিয়ান ফটোগ্রাফার মাহেদার হাইলেসেলাসি মূলত শুকিয়ে যাওয়া নদী এবং ধ্বংস হওয়া শস্যক্ষেত্র নিয়ে কাজ করেন। তিনি তাঁর ফটোগ্রাফিতে তুলে ধরেছেন কীভাবে মারাত্মক খরা, পরিবারগুলোকে তাদের কন্যাশিশুদের বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য করছে। এই কাজের জন্য ২০২৩ সালে তিনি কনটেম্পোরারি আফ্রিকান ফটোগ্রাফি পুরস্কার জিতেছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, জলবায়ু সংকটের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পাবে।
৬. রোসা ভাসকেজ এসপিনোজা, পেরু
-রাসায়নিক জীববিজ্ঞানী
জীববিজ্ঞানী রোসা ভাসকেজ এসপিনোজা তার দাদীর ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পেরুর আমাজন রেইনফরেস্টের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি জঙ্গলের অপরিচিত জীববৈচিত্র্য খুঁজতে আমাজন রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি আমাজনের বিখ্যাত ‘বয়লিং রিভার’ বা ফুটন্ত নদীতে নতুন ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেছেন। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম আদিবাসী গোষ্ঠী আষানিংকা জনগণের আন্তর্জাতিক দূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
৭. ব্রিজিট ব্যাপটিস্টে , কলম্বিয়া
-ইকোলজিস্ট
ট্রান্সউইম্যান জীববিজ্ঞানী ব্রিজিট ব্যাপটিস্টে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতি এবং প্রজাতি বিশ্লেষণ করেন, যাতে ‘প্রকৃতি’ ধারণাটিকে সম্প্রসারিত করা যায় এবং বাস্তুতন্ত্রকে আরো ভালোভাবে রক্ষা করা যায়। ২০১৮ সালের ‘টেডএক্স’ আলোচনায় তিনি কলম্বিয়ার জাতীয় গাছ ‘কুইন্দিও মোম পামে’র উদাহরণ দিয়েছিলেন। এ গাছটি জীবনের বিভিন্ন সময়ে পুরুষ থেকে নারী লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পরিচিত। বর্তমানে তিনি বোগোটার ইউনিভার্সিদাদ ইএএন-এ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এটি মূলত টেকসই উদ্যোগে জোর দেয়া একটি উচ্চ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান।
৮. নেজলা ইশিক, তুরস্ক
-গ্রামপ্রধান এবং বন রক্ষাকর্মী
তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলের ইকিজকয় এলাকার নবনির্বাচিত প্রধান এবং কৃষক নেজলা ইশিক বিগত পাঁচ বছর ধরে বনাঞ্চল ধ্বংসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। যখন কয়লাখনির প্রস্তাবের কারণে আকবেলেন জঙ্গল হুমকির মুখে পড়ে, তখন ইশিক এবং স্থানীয় নারীরা জমি পরিষ্কারের জন্য কাঠ কাটার কাজ বন্ধ করতে মামলা এবং বিক্ষোভের মাধ্যমে লড়াই করেন। বন রক্ষার জন্য তিনি হুমকির সম্মুখীন হলেও লড়াই চালিয়ে যান। তিনি বলেছেন- “বাড়িতে, মাঠে, রাস্তায়, কিংবা সংগ্রামে—নারীরাই বিশ্বকে সুন্দর করে তুলছেন, এবং নিশ্চিতভাবেই তারা এটিকে রক্ষা করবেন”।
৯. এনাস আল-গুল, ফিলিস্তিন
-কৃষি প্রকৌশলী
ফিলিস্তিনের গাজায় যখন যুদ্ধের কারণে তীব্র পানির সংকট দেখা দেয়, তখন এনাস আল-গুল এর সমাধান খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হন। তিনি কাঠ, কাচ ও ত্রিপলসহ পুনর্ব্যবহৃত নানা উপকরণ দিয়ে একটি সৌরশক্তি চালিত লবণাক্ত পানি শোধন যন্ত্র তৈরি করেন। যাতে এই যন্ত্র ব্যবহার করে সমুদ্রের পানিকে পানযোগ্য করা সম্ভব হয়। এই যন্ত্রটি গাজা উপত্যকার দক্ষিণে খান ইউনিস অঞ্চলের তাঁবুতে বসবাসরত বহু মানুষের জন্য জীবনরক্ষা কবচ হয়ে উঠেছে। তিনি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করতে সৌরশক্তি চালিত কুকারও তৈরি করেছেন।
১০. নাওমি চান্ডা, জাম্বিয়া
-কৃষক এবং প্রশিক্ষক
নাওমি চান্ডা পেশায় একটি প্রশিক্ষণ খামারের কৃষি গাইড। তিনি সাধারণত ‘জলবায়ু-স্মার্ট’ দক্ষতার ওপর জোর দেন। যেমন- কম পানি ব্যবহারকারী ড্রিপ সেচ, অথবা স্বল্প-সময়ের ফসল চাষ। তিনি নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের কেন্দ্র মনে করেন। মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিও ‘ক্যামফেড’-এর সঙ্গে তিনি প্রায় ১৫০ তরুণীকে কৃষি প্রযুক্তি মানিয়ে নেওয়া এবং তা জলবায়ু সংকটের মুখে টিকে থাকার উপযোগী করে তোলার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
১১. আডেনিকে টিটিলোপে ওলাদোসু, নাইজেরিয়া
-জলবায়ু আইনজীবী
নাইজেরিয়ান জলবায়ু আইনজীবী আডেনিকে টিটিলোপে ওলাদোসু ‘আই লিড ক্লাইমেট অ্যাকশন’ এর প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠান নারী এবং তরুণদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোগ। তিনি তার কাজের মাধ্যমে পরিবেশগত এবং সামাজিক উভয় সমস্যার সমাধান করেন, বিশেষত যা আফ্রিকান নারীদের প্রভাবিত করে। তিনি খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলে টেকসই কৃষিতে নারীদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য কাজ করেন।
বিবিসি প্রভাবশালী ১০০ নারী প্রতিবেদনে স্থান করে নেওয়া এগারো জন জলবায়ু কর্মীই অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁরা তাদের অদম্য সাহস, নিরলস পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে জলবায়ু সংকট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। এই নারীরা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, আমাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত।
Comments