গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়শা মারিয়া
বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মিউজিক স্ট্রিমিং এবং মিডিয়া সার্ভিস প্রোভাইডার হলো স্পটিফাই। এটি বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য ফ্রি ভার্সন ও প্রিমিয়ার ভার্সন উভয়ই রয়েছে। স্পটিফাইয়ের সবচেয়ে মজার যে ফিচার সঙ্গীতপ্রেমীদের আকর্ষণ করে, তা হলো–’স্পটিফাই ব্যবহারকারীর মন বুঝে গান শোনায়!’
কিন্তু আমাদের জানতে হবে স্পটিফাই কীভাবে তা বোঝে? আজকাল মানুষ তো একে অন্যকে মুখ ফুটে বললেও অনেক সময় কথা বোঝা দায় হয়ে যায় আর সেখানে স্পটিফাই’র এত ভালো বোঝাপড়ার কৌশল জানতেই আজকের লেখাটি আপনাকে পড়তে হবে।
৫ মিলিয়নের বেশি পডকাস্ট, ১০০ মিলিয়নের বেশি মিউজিক এবং ৪ বিলিয়নের বেশি প্লে লিস্ট নিয়ে স্পটিফাই তে বর্তমানে বিশ্বের ১৮৪ টি দেশ থেকে মিউজিক পডকাস্টসহ বিভিন্ন ধরনের অডিও কনটেন্ট উপভোগ করছে। বাংলাদেশেও স্পটিফাই দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
বিশ্বব্যাপী স্পটিফাই এর মাসিক ৬১৫ মিলিয়নের মত সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে। এছাড়াও মিউজিক স্ট্রিমিং ইনডাস্ট্রিতে ৩১.৭% মার্কেট শেয়ার নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে রয়েছে।
স্পটিফাই এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে সুইডেনের স্টকহোমে সুইডিশ উদ্যোক্তা ড্যানিয়েল এক এবং মার্টিন লরেন্টজন এর হাত ধরে। তাদের দুই বছরের প্রচেষ্টায় ২০০৮ সালে স্পটিফাই লঞ্চের অনুমোদন লাভ করে এবং অক্টোবর মাস থেকে সুইডেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে মিউজিক স্ট্রিমিং এর কাজ শুরু করে স্পটিফাই। শুরুতে স্পটিফাই মিউজিক ফ্যান দের ইনভাইটেশন এর মাধ্যমে এবং এড দেখানোর মাধ্যমে ফ্রি তে গান শোনার সুযোগ করে দিত তবে কিছুদিনের মাঝেই পেইড সাবস্ক্রিপশন ও নিয়ে আসে।
স্পটিফাই এর মুনাফা সেরকম চোখে পড়ার মত না হলেও প্রতি বছর কোম্পানিটির ব্যবহারকারির সংখ্যা ও রাজস্ব আয় বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৮৪টি দেশে স্পটিফাই থেকে মিউজিক, পডকাস্ট, অডিও বুক ও ছোট গল্প শুনছে শ্রোতারা।
কেন ব্যবহারকারি দের মাঝে স্পটিফাই এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে চলুন জেনে নেই।
স্পটিফাই এর জনপ্রিয়তার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে প্ল্যাটফর্মটিতে লিসেনিং এক্সপেরিয়েন্স রয়েছে। স্পটিফাই এ্যাপ টির ইউজার ইন্টারফেজ একেবারেই সাধারণ। এখানে গানগুলি প্লে-লিস্ট আকারে সাজানো থাকে ফলে ব্যবহারকারীরা কোনো মিউজিক সার্চ করে শোনার পর একই রকম গান একের পর এক বাজতে থাকে। স্ট্রিমিং সার্ভিসটি প্লে-লিস্ট তৈরির ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের দুর্দান্ত সমন্বয় ঘটিয়ে প্রযুক্তিকে আরো বেশি ‘প্রো’ মাত্রায় নিয়ে যেতে স্পটিফাই প্রতিটি কাস্টমার তথা শ্রোতার পছন্দের ভিত্তিতে অভিজ্ঞতা তৈরির চেষ্টা করে। এর জন্য সম্প্রতি তারা কিছু ডেটা সায়েন্স কোম্পানির সহায়তাও নিচ্ছে, যাতে করে মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের কাতারে ‘স্পটিফাই’ নামটিই এগিয়ে থাকে।
অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলোতে স্ট্রিমিং সার্ভিসে একই রকম পদ্ধতি ব্যবহার করলেও স্পটিফাই এর মেশিন লার্নিং টুলটি বেশ শক্তিশালী। এই প্ল্যাটফর্মে নতুন কোনো শিল্পীর গান আসার পর অনলাইন উপস্থিতি অত সরগরম না হলেও গানের ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে শ্রোতার প্লে-লিস্টে সেটি যুক্ত করা সম্ভব হয়। এখানে জনপ্রিয়তার চেয়েও বেশি শ্রোতার ব্যক্তিগত পছন্দ প্রাধান্য পায়। শ্রোতা যদি এই শিল্পীর গান, বা তিনি যে ধরনের গান পরিবেশন করেন, সেসব গান বেশি পছন্দ করে থাকেন—তাহলে স্পটিফাই’র অডিও মডেল সেই গানটিই তার শোনার জন্য সুপারিশ করবে। ১০০মিলিয়নেরও বেশি মিউজিক থেকে পছন্দমত একের পর এক মিউজিক সাজেশন এর তালিকায় আসার কারণে স্পটিফাই ব্যবহারের সমৃদ্ধি বেড়ে চলেছে।
স্পটিফাই স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, ট্যাব থেকে শুরু করে স্মার্ট হোম ডিভাইস, স্মার্ট ওয়াচ, প্লে স্টেশন এবং এক্স বক্স এর মত ডিভাইস গুলোতেও সাপোর্ট করে। এছাড়াও ওয়েব ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্রাউজার থেকে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়।
স্পটিফাই এর জনপ্রিয়তার অন্যতম আরো একটি কারণ হচ্ছে এখানে বিনামূল্যে বা ফ্রিমিয়াম এ গান শোনার ব্যবস্থা রয়েছে। বিনামূল্যে শ্রোতারা প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ছয়টি অডিও স্কিপ করতে পারবেন। অন্যদিকে প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশনে অডিও স্কিপ এ থাকেনা কোনো সীমাবদ্ধতা। ফ্রিমিয়াম এ অডিও শুনতে হলে প্রিমিয়ামের থেকে এর গুণগত বৈশিষ্ট্য বেশ কমই থাকে। এছাড়া সকল সুবিধা একই থাকে। এছাড়া প্রিমিয়াম ও ফ্রিমিয়ামের সুবিধার খুব বেশি পার্থক্য না থাকাই ব্যাবহারকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন এ অফলাইনে গান শুনতে পারার ও সুযোগ রয়েছে। বিনামূল্যে ব্যবহারকারীদের গানের মাঝে বিজ্ঞাপন শুনতে হলেও প্রিমিয়ামে আবার সে অভিজ্ঞতা নেই। স্পটিফাই এর প্রাইসিং এও বিভিন্ন ফ্যাক্টর রয়েছে যা অন্যান্য মিউজিক প্ল্যাটফর্মের তুলনায় সাধারন এবং সাশ্রয়ী।
স্পটিফাই নিজেদেরকে শুধু মিউজিকে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য অডিও কন্টেন্ট যেমন পডকাস্ট, অডিও বুক, শর্ট স্টোরিস এসবও রাখছে যা মিউজিকের মত ব্যবহারকারীরা ফ্রি একাউন্ট থেকেও এসব উপভোগ করতে পারবে।
স্পটিফাই এর সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দী হচ্ছে এপল মিউজিক, ইউটিউব মিউজিক এবং আমাজন মিউজিক। এই তিনটি মিউজিক স্ট্রিমিং কোম্পানিগুলোর মেশিন লার্নিং প্রসেস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা ব্যবহারকারীদের পছন্দমত অডিও সাজেশন লিস্টে যোগ করার ক্ষমতা একই রকম হলেও স্পটিফাই সব মিলিয়ে সংগীতপ্রেমিদের তুলনামুলক বেশি সুবিধা দিচ্ছে। তাই স্পটিফাইকে এক কথায় বলা যায় অলরাউন্ডার যা মিউজিক লাভার দের সবরকমের সার্ভিস তাদের চাহিদামত প্রদান করতে সক্ষম।
স্পটিফাই হলো সঙ্গীতপ্রেমীদের অবিরত সুরের রাজ্যে নিজেদেরকে ডুবিয়ে রাখার একটি মাধ্যম। স্পটিফাই এর বিশেষত্ব হলো এতে যখন কোনো শ্রোতা ব্যায়াম করতে করতে গান শুনতে থাকবেন তখন এটি মাঝপথে থেমে ঘুমপাড়ানি গান কখনোই সুপারিশ করবেনা এবং এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত থাকাই যায়। তাহলে এবার বলুন স্পটিফাই নিয়ে আপনি কি ভাবছেন?
Comments