কারেন্সী

বাংলাদেশ সরকার কেন ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অনিচ্ছুক?

0

গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তায়্যিবা

আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাতের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত টাকার পাশাপাশি আরও এক বিশেষ ধরণের মুদ্রা চালু আছে। একে বলে ডিজিটাল কারেন্সি বা ক্রিপ্টোকারেন্সি। তবে উন্নত অনুন্নত নানা দেশে এই মুদ্রা চালু থাকলেও বাংলাদেশে তা এখনও হয়নি। যদিও এর পেছনে সরকারের নানা যুক্তি রয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশ সরকার ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েনের মতো বৈদ্যুতিক মুদ্রা গ্রহণে কেন অনিচ্ছুক।

দেশে বৈদ্যুতিক মুদ্রা চালু না হওয়ার পিছনে অনেকগুলি কারণ রয়েছে, যার বেশিরভাগই মূলত আইনি, আর্থিক এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত।

.আইনি নীতিগত প্রতিবন্ধকতা

প্রথমেই আসি আইনি নীতিগত প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের আর্থিক আইন ১৯৪৭ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট মেনে চলে। এই অ্যাক্ট অনুযায়ী কোনো ডিজিটাল কারেন্সি বা ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈধ মুদ্রা হিসেবে গণ্য করা হয় না। এই আইন অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন বৈধ হলেও, ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সেই পর্যায়ে আনতে আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। তাই বিটকয়েন, ইথেরিয়ামের মতো ডিজিটাল মুদ্রা বা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি দেশে বিনিয়োগ বা লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের আইনি কাঠামো ক্রিপ্টোকারেন্সিকে একটি অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ধরনের লেনদেনকে অনৈতিক বলে দাবী করে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির আইনি ও নীতিগত প্রতিবন্ধকতা, যা বাংলাদেশের সরকারকে এর ব্যবহারে অনিচ্ছুক করে তুলছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির আইনি ও নীতিগত প্রতিবন্ধকতা। | ছবি: সংগৃহীত

. অর্থ পাচার অপরাধের ঝুঁকি

ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের ফলে অর্থ পাচার অপরাধের ঝুঁকি বাড়ে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সি দ্বারা সংগঠিত সম্ভাব্য অপরাধমূলক ব্যবহারের বিরুদ্ধে বারবার সতর্ক করেছে। বেনামী লেনদেনের সুযোগ থাকায় এবং লেনদেন ব্যাবস্থা বিকেন্দ্রিকরণ হওয়ায়, ক্রিপ্টোকারেন্সি অর্থ পাচার এবং সন্ত্রাসী অর্থায়নের জন্য ব্যবহার হওয়া তুলনামূলক সহজ। কারণ, এই মুদ্রার লেনদেন সহজেই আন্তর্জাতিক সীমা অতিক্রম করতে পারে এবং কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্র বা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশে এটি চালু হলে আর্থিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। যা মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট , ২০১২ ও অ্যান্টি টেররিজম অ্যাক্ট , ২০০৯ এর সরাসরি লঙ্ঘন। এই আইন গুলো অনুযায়ী তাই এসব গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও অপরাধের ঝুঁকি, যা বাংলাদেশের সরকারের উদ্বেগের অন্যতম কারণ।

ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অর্থ পাচার ও অপরাধের ঝুঁকি। | ছবি: সংগৃহীত

. আর্থিক ঝুঁকি এবং মূল্যের অস্থিতিশীলতা 

ক্রিপ্টোকারেন্সির অস্থিতিশীলতা বা মূল্য পরিবর্তন দেশের জন্য একটি বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত। ক্রিপ্টোকারেন্সির মান সাধারণত বাজারে বেশ ওঠানামা করে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিপজ্জনক। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কারণ এর অভ্যন্তরীণ কোনো মুল্য নেই এবং এটি কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র বা সরকার দ্বারা পরিচালিত নয়। এর ফলে, দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। এই কারণে সরকার দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের প্রতি অনিচ্ছুক।

. ক্রিপ্টোকারেন্সির বিকেন্দ্রীকরণ প্রকৃতি এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাব

বাংলাদেশের সরকার দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দেয়। এতে করে সরকার চায় আর্থিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে। ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রকৃতি  বিকেন্দ্রীকৃত হওয়ায় এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, যেকোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে, যা  ক্রিপ্টোকারেন্সির নীতির সাথে বৈপরীত্য প্রকাশ করে। এর ফলে দেশের আর্থিক অপরাধের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

. প্রতারণার ঝুঁকি

বিশ্বজুড়ে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হলেও, এর সাথে প্রতারণার ঘটনাও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধরনের প্রতারণার কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা বাংলাদেশ সরকারকে আরও বেশি সতর্ক করেছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সিতে প্রতারণার ঝুঁকি, যা এর ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশের সরকারের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সিতে প্রতারণার ঝুঁকি, যা ব্যবহারকারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। | ছবি: সংগৃহীত

আশার কথা হচ্ছে, যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, সরকার ডিজিটাল টাকা নামে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমর্থিত ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার চিন্তাভাবনা করছে। এই মুদ্রাটি ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো বিকেন্দ্রীভূত হবে না; বরং এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ডিজিটাল টাকা দেশের ভেতরে বৈদ্যুতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে এবং এটি একটি নিয়ন্ত্রিত আর্থিক কাঠামোর মধ্যে থাকবে, যা ক্রিপ্টোকারেন্সির ঝুঁকিগুলিকে এড়াতে সাহায্য করবে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সরকার মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা , অবৈধ কার্যকলাপ রোধ, এবং দেশের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈধতা রয়েছে, বাংলাদেশ তার নিজস্ব আর্থিক সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এর বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে।

“তথ্যসূত্র”

শিশুদের জন্য ইউটিউবকে সুরক্ষিত করতে অভিভাবকদের ৬টি করণীয় পদক্ষেপ

Previous article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *