মার্কেটিং ট্রেন্ডস এন্ড আইডিয়াস

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সফলতার পথে ‘বাটা’

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার

স্কুলের প্রথম জুতা হোক, ঈদ কিংবা পূজার জন্য হোক, জুতা শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথম আসে বাটা কোম্পানির কথা। আমাদের সকলেরই বাটা কোম্পানির জুতার সাথে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। আচ্ছা তাহলে বাটা কি শুধু বাংলাদেশেই জনপ্রিয়? এর উত্তর হলো ‘না’। বাটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বরং সারাবিশ্বে  ব্যাপক জনপ্রিয়। 

বিশ্বব্যাপী বাটা প্রতিদিন এক মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহককে সেবা দিয়ে থাকে। ৭০ টিরও বেশি দেশে তাদের আউটলেট রয়েছে এবং ২০ টি দেশে তাদের পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে। বাটা কোম্পানি সারাবিশ্বে বছরে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন জোড়া জুতা বিক্রি করে! চলুন জেনে নেই কিভাবে মাত্র ১০ জন কর্মচারী নিয়ে শুরু করা একটি কোম্পানি আজ পরিণত হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীর বৃহৎ ফুটওয়্যার কোম্পানিতে।

বাটা কোম্পানি যাত্রা শুরুর গল্প 

২১ শে সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ সালে টমাস বাটা, তাঁর ভাই অ্যান্টোনিন এবং তার বোন অ্যানা -এর হাত ধরে চেকোস্লোভাকিয়ার গ্রামীণ শহর যেলিনে টি  বাটা কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। বাটা পরিবার প্রজন্ম ধরে মুচি ছিলো। টমাস, অ্যান্টোনিন এবং অ্যানা হলেন বাটা পরিবারের অষ্টম প্রজন্ম। তারা শুরু থেকেই উদ্ভাবক ছিল এবং কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে একটি নির্দিষ্ট কাজের সময়সূচী, একটি নিয়মিত সাপ্তাহিক মজুরি সহ ১০ জন পূর্ণ-সময়ের কর্মচারী নিয়োগ করেছিল।

১৮৯৪ সালে টমাস বাটা, তার ভাই অ্যান্টোনিন এবং বোন অ্যানা, চেকোস্লোভাকিয়ার যেলিনে গ্রামে বাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করছেন।

১৮৯৪ সালে টমাস বাটা ও তার ভাইবোনের হাত ধরে চেকোস্লোভাকিয়ার যেলিনে গ্রামে বাটা কোম্পানির যাত্রা শুরু। | ছবি সংগৃহীত।

১৮৯৭ সালে প্রথম বাষ্পচালিত জুতা তৈরির মেশিনসহ যান্ত্রিক উৎপাদন কৌশলগুলোর প্রবর্তন হলে, কোম্পানিটি দ্রুত আধুনিকীকরণের মাধ্যমে  ইউরোপের প্রথম বৃহৎ জুতা  উৎপাদনকারী কোম্পানিতে পরিণত হয়। ১৮৯৯ সালে বাটা কোম্পানি তাদের প্রথম স্টোর চেকোস্লোভাকিয়ার যেলিনে চালু করে। ১৯০৫ সালে দিনে ২,২০০ জোড়া জুতার উৎপাদন করে বাটা ইউরোপের বৃহত্তম জুতা কোম্পানিতে পরিণত হয়।  

সফলতার শুরু

বাটা কোম্পানির প্রথম সফলতা আসে বাটোভকা জুতা দিয়ে। বাটোভকা তার সরল ডিজাইন, শৈলী এবং হালকা ওজনের জন্য জনপ্রিয় হয়েছিল। চামড়া এবং ক্যানভাসের উদ্ভাবনী সংমিশ্রণ তৈরী এই জুতার কোয়ালিটি ছিলো বেশ উচ্চমানের। ফলে বাটা রকেটের গতিতে তার সফলতা দেখতে পায়। ১৯১৯ সালে বাটা মহিলাদের জন্য চামড়ার উন্নতমানের জুতা নিয়ে আসে। 

১৯৩৬ সাল থেকে বাটার স্বর্ণযুগ শুরু হয়। এসময় বাটা কোম্পানি ‘বাটা টেনিস’ জুতা বাজারে নিয়ে আসে। এই জুতা মূলত ভারতীয় স্কুলের বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো। এই জুতা সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া জুতাগুলোর মধ্যে একটি। সারা বিশ্বে এখনও এই মডেলের জুতা বিক্রি হয় ৷ বর্তমানে ৫টি মহাদশের ৭০ টি দেশে তাদের আউটলেট রয়েছে।

বাটা এবং বাংলাদেশ

বাটা ১৯৬২ সালে বাংলাদেশে তার কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে বাটা কোম্পানি বাংলাদেশে ২টি উৎপাদন কেন্দ্র পরিচালনা করছে। একটি টঙ্গীতে এবং অন্যটি ধামরাইয়ে। টঙ্গীতে স্কুলের জুতা, পিভিসি জুতা, স্যান্ডেল, চপ্পল এবং টেক্সটাইল  ভিত্তিক জুতা উৎপাদিত হয়। অন্যান্য ধরনের জুতা যেমন চামড়া জুতা, ব্যাগ ধামরাইয়ে উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশে জেলা ও থানা পর্যায়ে বাটার প্রায় ২৪২টি স্টোর রয়েছে।

১৯৬২ সালে বাংলাদেশে বাটা কোম্পানির কার্যক্রম শুরু।

বাটা ১৯৬২ সালে বাংলাদেশে তার কার্যক্রম শুরু করে। | ছবি সংগৃহীত।

আর্থিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি- সেপ্টেম্বরে বাটা কোম্পানি বাংলাদেশে ৭৫৪ কোটি টাকার সেল করে এবং প্রফিট অর্জন করে ৪২ কোটি টাকার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বাটা কোম্পানির শীর্ষ ১০টি বাজারের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে বাটা যে জুতা বিক্রি হয় তার ৮৫ শতাংশেরও বেশি তৈরি করা হয় বাংলাদেশে অবস্থিত বাটার নিজস্ব কারখানায়। বাটা শু ফাউন্ডেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মনিকা পিগনাল। 

বাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনের জন্য ২০ সেপ্টেম্বর,২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি জানান বাটা কোম্পানির জন্য বাংলাদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি মার্কেট। আর তাই বাংলাদেশ নিয়ে তাদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে।

বাটা কোম্পানির বিজনেস স্ট্র্যাটেজি

প্রতিষ্ঠা হওয়ার ১২৫ বছর পরেও বাটা কোম্পানি দ্বিতীয় গ্লোবাল ফুটওয়্যার কোম্পানি এবং একটি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন আইকন। বর্তমানে বাটা কোম্পানির অধীনে ২০ টিরও বেশি ব্র্যান্ড এবং লেভেল রয়েছে। যেমন- নর্থ স্টার, পাওয়ার, বাবলগামারস, ওয়েইনব্রেনার, স্যান্ডাক বা টগিস ইত্যাদি। এখন আমরা বাটা কোম্পানির বিজনেস স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো- 

মার্কেটিং

বাটা কোম্পানি তার সৃজনশীল মার্কেটিং কৌশল বাস্তবায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী নিজেকে সেরাদের তালিকায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন- “ধনুষ্টংকার হইতে সাবধান, সামান্য ক্ষত হইতে মৃত্যু ঘটিতে পারে, জুতা পরুন।” এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে, লোকেরা জুতা পরার বিরুদ্ধ ছিল। আর তখন বাটা এই বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ব্যবহার করে যা ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে বাটানগর নিউজে প্রকাশিত হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটি প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়েছে কীভাবে ১৩০ বছর বয়সী কোম্পানিটি লোকেদের স্যান্ডেল পরার অভ্যাস তৈরিতে অবদান রেখেছিল।

বাটা কোম্পানির সৃজনশীল মার্কেটিং কৌশল।

বাটা কোম্পানি তার সৃজনশীল মার্কেটিং কৌশলের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করে। | ছবি সংগৃহীত।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাটা নিজেদের পণ্যের গুণমান বজায় রেখে জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ এবং  আনুষাঙ্গিকগুলোর জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। লোকেরা বাটা থেকে পণ্যের স্থায়িত্ব আশা করে কারণ কোম্পানিটি এজন্য বেশ পরিচিত। আর বাটা জুতা এখন পর্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে পাওয়া সবচেয়ে টেকসই জুতাগুলোর মধ্যে একটি। সাশ্রয়ী মূল্যে টেকসই জুতা উৎপাদনের এই কৌশলটি বাংলাদেশে বাটাকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছে। কারণ দেশের গ্রামীণ নাগরিকরা স্থায়িত্ব খোঁজে এবং একই সময়ে বেশি খরচ করতে চায় না। এক্ষেত্রে বাটার স্থানীয় উৎপাদন ইউনিটগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয়, ঈদ, পূজা কিংবা বছরের নানা উৎসবের সময় বাটা ডিস্কাউন্ট অফার করে। তাদের এই মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি বাটাকে করে তুলেছে অনন্য। 

দাম

দাম সবসময়ই বাটা-এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিপণন কৌশল। বাটা তার মূল্য নির্ধারণের কৌশল হিসাবে মনস্তাত্ত্বিক মূল্য ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করেন, বাটা পণ্যের বেশিরভাগ দাম নয় নম্বর দিয়ে শেষ হয়। এই ঘটনাটি ছাড়াও, সাধারণভাবে, বাটা তার জুতার দাম খুব মাঝারিভাবে রাখে এবং সেগুলিকে সাশ্রয়ী রাখে যাতে যে কেউ সহজেই এটি কিনতে পারে। এমনকি এখন বাজারে বাটা রাবারের স্লিপার পাওয়া যাচ্ছে যেগুলোর দাম ১০০ টাকার নিচে। 

স্থান 

শো-রুমের জন্য স্থান নির্বাচন বিজনেসে সফল হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।বাটার শক্তি হল এর গ্রামীণ বিতরণ চ্যানেল। দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সর্বমোট ২৬২টি বাটা স্টোর রয়েছে। রাজধানী ঢাকার উন্নত এলাকা ধানমণ্ডি, বনানী, গুলশান এলাকাতে যেমন বাটার শো-রুম রয়েছে, তেমনি রয়েছে কারওয়ান বাজার, গুলিস্তান কিংবা টঙ্গীর মতো এলাকায়। শহরের অভ্যন্তরে বাটার যেসকল স্টোর রয়েছে তা মূলত মেইন রোডের পাশে অবস্থিত। আর প্রধান রাস্তার বেশিরভাগ দোকানই নিচতলায় অবস্থিত। এই ধরনের গ্রাউন্ড ফ্লোর অবস্থানের পিছনে সম্ভাব্য যুক্তি হলো যাতে ক্রেতারা সহজেই রাস্তায় হাঁটাহাঁটির সময়েও বাটার জুতার কালেকশন দেখতে পারে।

বাটা শো-রুমের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করছে।

বাটা শো-রুমের জন্য কৌশলগত ও উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে। | ছবি সংগৃহীত।

প্রচারমূলক কার্যক্রম

বাটা প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকেই মিডিয়া বা সংশ্লিষ্ট পাবলিক প্রচারে ব্যাপকভাবে ব্যয় করেনি। বরং এর পরিবর্তে, এটি শোরুমে আরও গ্রাহকদের টানতে ব্র্যান্ড ইক্যুইটিতে বিশ্বাস করেছিলো। আর তাই তারা মূলত টেকসই পণ্য উৎপাদনে বেশি নজর দিয়েছিলো।

তবে বাংলাদেশে বাটা তাদের ডিস্কাউন্টের অফার সম্পর্কে জানাতে কিংবা উৎসব উপলক্ষ্যে তাদের তৈরী করা নতুন পণ্য সম্পর্কে জানাতে ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। আর ডিজিটাল এই যুগে অন্য যেকোনো ব্র্যান্ডের মতো বাটাও তাদের পণ্য প্রচার করতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও বাটা একমাত্র কোম্পানি যারা বাংলাদেশে অ্যাডিডাসের জুতা আমদানি করে।

গত ৬২ বছর ধরে বাটা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। বাটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এতো বেশি সুপরিচিত যে, এই বিদেশি জুতা কোম্পানিটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি। বাটার সিইও সন্দীপ কাতারিয়া বলেছেন, ফুটওয়্যার শিল্পের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্বব্যাপী সোর্সিং হাব। বিশ্বব্যাপী বাটার জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তাদের সৃজনশীল বিজনেস স্ট্র্যাটেজি।

“তথ্যসূত্র”

স্টারবাকসের ‘প্রিমিয়াম অভিজ্ঞতা’ কৌশল : গ্রাহক ধরে রাখার মাস্টারপ্ল্যান

Previous article

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ক্যামেরাঃ ইনস্টা৩৬০ গো ৩

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *