গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা মোঃ ইসফাকুল কবির
বর্তমানে মোবাইল ব্যাবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপ। এর গ্রাহক বান্ধব সেবা এবং নিরাপত্তার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমান পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ হোয়াটসঅ্যাপের ব্যাবহার করে। তবে গ্রাহকদের সেবা দেয়ার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে এ কোম্পানিটি যাত্রা শুরু করেছিল আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে। জ্যান কউম ও ব্রায়ান অ্যাক্টন দুই তরুণের হাত ধরে হোয়াটস অ্যাপের এইড যাত্রা শুরু হয়।
জ্যান কউম বর্তমান সময়ে সেরা বিলিয়নিয়ার দের একজন। তার মোট সম্পদের মূল্য আজ ৯.৯ বিলিয়ন। তবে আজকের কউমের সফলতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক দারিদ্রতা, হতাশা, নিজ দেশ ছাড়ার বেদনা। তার জীবনকে সিনেমার গল্প বললেও ভুল হবে না। জ্যান কউম জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, বর্তমানে যা ইউক্রেনের অংশ। সে সময় কাউমের মা তাকে নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় পারি জমিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারকে সহ্য করতে হয়ে ছিলো চরম দারিদ্রতা। চরম দারিদ্রতাকে পাশ কাটিয়ে কাউম গড়েছেন বর্তমানের বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হোয়াটসঅ্যাপ। তবে এক সময় তার কম্পানি থেকেই তাকে সরে যেতে হয়েছিলো। তবে আজও নতূন উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে জ্যান কউম একটি অনুপ্রেরণার নাম। শূণ্য থেকে কিভাবে তিনি আজকের এই পর্যায়ে পৌছালেন চলুন জেনে নেয়া যাক।
দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই
১৯৭৬ সালে ইউক্রেনের কিয়েভে শহরে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কউম। তার বাবা ছিলেন একজন নির্মাণ শ্রমিক। তার ছেলেবেলা কেটেছিল কমিউনিস্টদের কঠোর শাসনামলে। কমিউনিস্টদের নেতিবাচক গোপনীয়তা সুরক্ষা নীতি কউমের মনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতনের পর কউমের মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নতুন অধ্যায় শুরু করবে আমেরিকায়।যেই কথা সেই কাজ । ১৯৯২ সালে তারা ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে যায়। তবে সেখানে তাঁদের জীবনে নেমে আসে চরম দারিদ্রতা। খেয়ে না খেয়ে সরকারের দেওয়া বাড়িতে থেকে তাঁদের জীবন কোনোরকম চলতে থাকে।এর মাঝে কউমের মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তখন বাধ্য হয়ে কউমকে দোকানে কাজ করে সংসার চালাতে হয়।
ইয়াহুতে চাকরি
কউম একজন কঠোর পরিশ্রমী ব্যাক্তি ছিলেন। এত সমস্যার মাঝেও আমেরিকাতে আসার দুই বছরের মাথায় সে নিজেকে শিখিয়েছিলেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। সে সময়ের সেরা হ্যাকিং গ্রুপ ‘’w00w00’’ তে কাজ করেছিলেন তিনি। যেখান থেকে তিনি সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে বিশদ জ্ঞান পেয়েছিলেন। এই ব্যাপারে কউম রয়টার্সকে বলেছিলেন, ” সেই দিন গুলি আমি অনেক আনন্দে কাটিয়ে ছিলাম যখন আমি নেটওয়ার্কিং, নিরাপত্তা , প্রসারণযোগ্যতা সম্পর্কে শিখছিলাম। বাংলা ‘ঝাঁকের কৈ’ একটি বাগধারায় আছে যার মানে এক দলে থাকা মানুষ গুলির বিশিষ্টে নাকি মিল থাকে। তার প্রমাণ মিলেছে এই হোয়াটসঅ্যাপের প্রতিষ্ঠাতার জীবনেও। মার্ক জুকারবার্গ, জ্যাক ডরসি এবং ল্যারি এলিসনের মতো তিনিও তার স্নাতক শেষ করতে পারেননি। সান জোসে স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েও ইয়াহুতে চাকরির কারণে ছাড়তে হয়েছিলো পড়াশোনা।
সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যাক্টনের সাথে পরিচয়
ব্রায়ান অ্যাক্টনের সাথে কউমের সাক্ষাত হয়ে ছিলো ইয়াহুর একটি প্রজেক্টে কাজ করার সময়। প্রায় এক দশক ধরে দুইজন ইয়েহুতে কাজ করেন। পরবর্তীতে চাকরি নিয়ে অসন্তোষ্টির ফলে দুজনেই ২০০৭ সালে ইয়াহু ছাড়েন। সে সময় তারা দুজনেই ফেসবুকে চাকরির জন্য আবেদন করলেও কোনো লাভ হয়নি। তবে কে জানতো কয়েক বছর পরে তাদের তৈরী প্রতিষ্ঠান কিনে নিবে ফেসবুক কিনে নিবে বিলিয়ন ডলার খরচ করে।
হোয়াটসঅ্যাপের জন্য আইডিয়া ডেভেলপ
ফেসবুক কে চাকরি না পাবার পরে দুইজন নতুন কোন প্রতিষ্ঠানে না যোগ দিয়ে ভাবলেন নিজেরাই একটা প্রযুক্তির আবির্ভাব করা যায়। সে সময় বাজারে এসেছিলো স্কাই। যা দেখে কউম ভাবলো কীভাবে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করা যায়। তার এই ধারণাকে নতুন কিছুতে রুপ দেবার আগে কউম তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যখন তিনি কিশোর ছিলেন, তখন তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অনিয়মিত। তাই তিনি চেয়েছিলেন ফোন কল বা মেসেজিং কিভাবে মানুষের মধ্যে আরো সহজ এবং সাবলীল করে তোলা যায়। যা বাস্তবে রূপ লাভ করে ২০০৯ সালে। এই ব্যাপারে তিনি একজন রাশিয়ান ডেভেলপারের সাহায্য নিয়েছিলেন।
হোয়াটসঅ্যাপের সফলতা
২০০৯ সালের মে মাসে অবশেষে হোয়াটসঅ্যাপে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। তবে প্রথম এক মাসে তারা তেমন কোন সফলতা পায়নি। অ্যাপেলের আইফোনের যখন তাঁদের পুশ নোটিফিকেশন সফটওয়্যার আপডেট করে তখনই ভাগ্য খুলে যায় হোয়াটসঅ্যাপের। সে সময় কউম তাঁদের অ্যাপ কে সামাজিক নেটওয়ার্ক হিসেবে নতুন করে গড়ে তোলে। অন্যদিকে অ্যাক্টন কোম্পানির ব্যবসায়িক কৌশলের দিকে নজর দেন। হোয়াটসঅ্যাপের গঠের ব্যাপারে কউম বলেন, ” আমি এমন একটি সমাজে বড় হয়েছি যেখানে আপনি যা করেছেন তা রেকর্ড করা করা হয়েছে। যা অন্য কারো শোনার অধিকার থাকা উচিত নয়।”
অবশেষে সেপ্টেম্বরে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন সংস্করণ সবার কাছে ব্যাপক সারা ফেলে। ব্রায়ান অ্যাক্টন জানিয়েছিলেন অ্যাপটি যখন সবার জন্য ফ্রী ছিলো তখন দিনে প্রায় ১০,০০০ ডাউনলোড হতো। তবে তারা যখনই চার্জ যোগ করেছিলেন তখন দৈনিক ডাউনলোডের সংখ্যা নেমে আসে ১০০০ হাজারে। এই সমস্যা সমাধানে অ্যাক্টনে এবং কউন সিদ্ধান্ত নিলেন যে ব্যাবহারকারীদের প্রথম এক বছর কোন টাকা পরিশোধ করতে হবে না তবে এক বছর পরে প্রতিবছর গ্রাহক কে গুণতে হবে ৯৯ সেন্ট। এই পদক্ষেপ তাদের প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক সফল্য এনে দিয়েছে।
হোয়াটসঅ্যাপ বেড়েওঠা
২০০৯ সালে সেপ্টেম্বরে নতুন সংস্করণের সফলতার পরে কউম এমন কাউকে খুজছিলেন যে তাঁদের মেসেজিং পরিষেবা বাড়াতে পারে এমন বিনিয়োগকারীদের সন্ধান করছিল। সে বছর অক্টোবরে, অ্যাক্টন ইয়াহুতে তাদের প্রাক্তন সহকর্মীদের মধ্যে থেকে ২৫০০০০ ডলার বিনিয়োগ পান। একদিকে অ্যাক্টন তাঁদের ব্যাবসায়িক দিক সামলাচ্ছিল অন্যদিকে কউন ব্যাস্ত ছিল কি ভাবে তাদের অ্যাপকে আরো উন্নত করা যায় এবং এটাকে ব্যবহারকারীদের জন্য কার্যকর করে তোলা যায়।দুই বন্ধু তাদের ব্যাবসার প্রবৃদ্ধি দেখছিল ঠিকই তবে এই অ্যাপকে পরিচালনা করে এতটা সস্তা ছিলো না, কারণ প্রতিমাসে গ্রাহকদের এসএমএস পাঠাতেই তাঁদের হাজার হাজার ডলার খরচ হতো।
২০১০ সালে এসেও তাদের মাসে লাভ থাকতো প্রায় ৫০০০ হাজার ডলারের ও কম। যার ফলে দুই প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা কয়েক বছর কোম্পানি থেকে কোন টাকা নিবেন না। এর ফলে তাঁদের সঞ্চয় করা টাকা থেকেও তাঁদের এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে বিনিয়োগ করতে হয়েছিল।
তাঁদের এই ব্যাপক পরিশ্রমের ফলে ২০১১ সাল থেকে নাগাদ অর্থ আশা শুরু করে। সে সময় অনেক বড় বড় বিনিয়গকারী তাদের সাথে যুক্ত হতে চাইলেও তারা তাদের দলে নিতে পারেননি। কারণ প্রতিষ্ঠানটির দুই সহ প্রতিষ্ঠাতা চেয়েছিলেন তাঁদের নিজের মত কাজ করতে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিজ্ঞাপন মুক্ত সেবা প্রদান। সে সময় তাঁদের এই বিজ্ঞাপন মুক্ত নীতিতে রাজি হয়েছিল সেকোইয়া ক্যাপিটালের জিম গোয়েটজ। তাইতো সেকোইয়া ক্যাপিটাল ২০১১ সালে হোয়াটসঅ্যাপে বিনিয়গ করে ৮ মিলিয়ন এবং ২০১৩ সালে বিনিয়ক করেছিল ৫০ মিলিয়ন। যা হোয়াটসঅ্যাপকে নতুন ভাবে সাঁজাতে সাহায্য করেছিল। এই অর্থ দিয়ে কউম ও অ্যাক্টন তাঁদের অফিসের স্থানের উন্নতি করেছে, জনবল বাড়িয়েছেলএবং কিছু নতুন ফিচার যুক্ত করেছিল হোয়াটসঅ্যাপে।
ফেসবুকের কাছে বিক্রি হোয়াটসঅ্যাপ
২০১৪ সালে ফেসবুক ১৯ বিলিয়ন দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেয়। সে সময় হোয়াটসঅ্যাপ ব্যাবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬৫ মিলিয়ন। দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা এর পরেও কয়েক বছর হোয়াটসঅ্যাপের সাথে ছিলেন।তবে কউম ও অ্যাক্টন তখনই হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়েছিল যখন তারা দেখল তাঁদের মূল দুই নীতির ঠিক ভাবে মেনে চলছে না ফেসবুক। যেগুলো ছিল বিজ্ঞাপন মুক্ত সেবা প্রদান এবং গ্রাহকদের নিরাপত্তা।
কউমকে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার দিতে চাইলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এবং পরবর্তীতে“হ্যাসট্যাগ ডিলিট ফেসবুক” আন্দোলন করেন।পরবর্তীতে কউম এবং অ্যাক্টন দুজনই তাঁদের উপার্জিত অর্থ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে। তারা চেয়েছিল তাঁদের অর্থ যেন মানুষের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা , ন্যায় এবং ইহুদি সম্প্রদায় ও ইসরাইলের কাজে লাগে।
Comments