Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা ইসফাকুল কবির |
উদ্যোক্তা মানে নতুন ব্যবসা বা প্রকল্প শুরু করা, সাধারণত এটি নির্ভর করে নতুন কোনো আইডিয়ার উপরে। যেমন যে কোনো পণ্য বা পরিষেবাপ্রদান, যা মানুষের জীবনে মূল্য যোগ করতে পারে বা অর্থ উপার্জন করার উপায়।
উদ্যোক্তারা হলেন সমাজের সেই সব ব্যাক্তি যারা তাদের নতুন ধারণা গুলি সমাজের কাছে উপস্থাপন করে। পাশাপাশি সেই ধারনাকে বাস্তবে কোনো ব্যবসায় রূপান্তর করতে কঠোর পরিশ্রম করেন। এই অসম্ভবকে সম্ভবে রুপান্তরিত করতে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা করে, সংগঠিত করে এবং পরিচালনা করে থাকে। যদিও তাদের এই যাত্রায় সবসময় কিছু অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকি জড়িত থাকেই। তবে অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তা সৃজনশীল উপায়ে সমস্যা সমাধান করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
উদ্যোক্তা তত্ত্ব সম্পর্কে কেন জানবেন?
কারণ এই তত্ত্ব গুলি একটি গাঠনিক কাঠামোর মাধমে আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কেনো এবং কিভাবে একজনের নেওয়া উদ্যোগ সফল হবে। এই তত্ত্বঃগুলি ব্যাখ্যা করে কেন একজন মানুষ উদ্যোক্তা হতে চায় , কেনো অন্যরা এটা থেকে দূরে থাকে এবং কোন বিষয় গুলি একটি ব্যবসাকে সফল ও ব্যর্থ করে। তত্ত্ব শেখার মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন কোন ব্যপার গুলি একজন উদ্যোক্তাকে উজ্জীবিত করে এবং কোন ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তারা হয়ে থাকে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বেশ কিছু উদ্যোক্তা তত্ত্ব ।
উদ্যোক্তা উদ্ভাবন তত্ত্বঃ
জোসেফ শুম্পেটার তার উদ্যোক্তা উদ্ভাবন তত্ত্বে বলেন, উদ্যোক্তা হলো সম্পূর্ণ উদ্ভাবন সম্পর্কিত। তিনি বলেন উদ্যোক্তারা নতুন পণ্য, পরিষেবা বা প্রক্রিয়া তৈরি করে যা বাজার পরিবর্তন করতে পারে এবং এর মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালাতে পারে। জোসেফ বলেন উদ্যোক্তারা সমাজের জন্য উদ্ভাবক রুপে কাজ করে। এই উদ্যোক্তাদের সাফল্য নির্ভর করে সৃজনশীলতা, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার এবং বাজারের প্রবণতা অনুমান করে কাজ করার উপর।
উদ্যোক্তা সাংস্কৃতিক তত্ত্বঃ
এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে কিভাবে সমাজের বিভিন্ন সাংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস উদ্যোক্তাদের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। প্রতিটা সমাজ ভিন্ন ভাবে সেখানকার উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে থাকে যা নির্ভর করে মূল্যবোধ, ঝুঁকি নেবার ক্ষমতা, উদ্ভাবন এবং ব্যাক্তিত্বের উপর।
উদাহরণস্বরূপ, যে সমাজ স্বাধীনতাকে মূল্য দেয় এবং সৃজনশীলতাকে পুরস্কৃত করে সেই সমাজে সফল উদ্যোক্তা তৈরি করার সম্ভাবনা বেশি। হফস্টেডের এই তত্বটি বুঝতে সাহায্য করে যে, কিভাবে সাংস্কৃতিক পার্থক্যগুলি সমাজ জুড়ে উদ্যোক্তা আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে।
৪ পিস অফ ক্রিয়েটিভিটি তত্ত্বঃ
মেল রোডস তার এই তত্বে বলেন যদি ব্যাক্তি, পণ্য, প্রক্রিয়া, জায়গা এই চারটি বিষয় নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তবে তা ব্যবসায় কিরুপ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ব্যক্তি : ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, কৌতূহল এবং ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা উদ্রোক্তাকে সৃজনশীল হতে সাহায্য করে।
প্রক্রিয়া: ব্যবসায় নতুন ধারণা যোগ করা। ব্যবসা বিকাশে করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা।
জায়গাঃ ব্যক্তির চারপাশের পরিবেশ, যেমন কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি বা সামাজিক প্রভাব, যা সৃজনশীলতা যা ব্যবসাকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে।
পণ্যঃ উদ্যোক্তার পরিশ্রমের শেষ ফলাফল হলো তার পণ্য। নতুন পরিষেবা বা ভিন্ন ধর্মী পণ্য যা ব্যবসাকে প্রভাবিত করতে পারে বিশেষভাবে।
উচ্চ মুনাফা অর্জনের তত্ত্বঃ
ডেভিড ম্যাকক্লেল্যান্ডের এই তত্বে বলে, মানুষ তার কাজে সফলতা পাবার জন্য নিজেকে অনুপ্রাণিত করে রাখে। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি যার উচ্চ মাত্রায় সফলতা পাবার ইচ্ছা থাকে তারা নিজেদের বিভিন্ন ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে তাদের লক্ষ পূরণ করে থাকে। যেমন,
চ্যালেঞ্জঃ উদ্যোক্তারা কঠিন কাজ করতে পছন্দ করে এবং বিচার বিবেচনার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে।
প্রতিক্রিয়াঃ ব্যবসায় উন্নতির জন্য উদ্যোক্তারা গঠনমূলক সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করে।
স্বাধীনতাঃ তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে চায়।
ঝুঁকি বহনকারী তত্ত্বঃ
ফ্র্যাঙ্ক হাইনেম্যান নাইট এই তত্ত্ব বলেন যে, উদ্যোক্তারা প্রায়ই ব্যবসায় অজানা ঝুঁকির সম্মুখীন হন এবং তারা এই সমস্ত অনিশ্চয়তা যুক্ত ঝুঁকি গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে আরও বেশি লাভের আসায়। তাদের এই অনিশ্চয়তা কাঁটাতে ব্যাংক এর মত অর্থ দানকারী প্রতিষ্ঠান গুলি কাজ করে থাকে। ফ্র্যাঙ্ক মনে করেন, ব্যবসায় অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি উদ্যোক্তার আরও বেশি লাভের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
উদ্যোক্তা বৃদ্ধির রাজনৈতিক সিস্টেম তত্ত্বঃ
একটি স্থিতিশীল এবং সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ উদ্যোক্তাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। যখন রাজনৈতিক অবস্থা ভালো থাকে এবং সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক নীতি প্রদান করে তখন মানুষ ব্যবসা করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এমন সহায়ক পরিবেশ উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়ায় এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
তথ্য সম্পদ-ভিত্তিক উদ্যোক্তা তত্ত্বঃ
সঠিক তথ্য থাকা উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসার সুযোগগুলি খুঁজে বের করা এবং তা অনুসরণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন,
আর্থিক মূলধনঃ একটি ব্যবসায় বিনিয়োগ করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা সম্পর্কে সঠিক তথ্য।
সামাজিক মূলধনঃ মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ এবং ভালো সম্পর্ক উদ্যোক্তাদের ধারণা গুলিকে ব্যবসায় রূপান্তর করতে সাহায্য করে।
মানব পুঁজিঃ সঠিক দিক নির্দেশনা এবং কাজ সম্পর্কিত দক্ষতা ব্যবসা বৃদ্ধি করতে পারে। মূলকথা হলো উদ্যোক্তাদের জন্য সঠিক তথ্য এবং সম্পদের ব্যাবস্থা থাকা প্রয়োজন যাতে তারা তাদের ব্যবসার উন্নতি ঘটাতে পারে।
উদ্যোক্তা প্রভাবের তত্ত্বঃ
এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে সফল উদ্যোক্তারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করলেও যদি তার পক্ষে তা এই মুহূর্তে সকল সম্পদের যোগার করা সম্ভব না হয়। তবে তার কাছে যা আছে তাই দিয়েই সে কাজ শুরু করে। তারা তাদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং যোগাযোগের উপর ফোকাস করে এবং তারা যতটুকু সম্পদের মালিক থাকে তার উপর ভিত্তি করেই তারা পরিকল্পনা সাঁজায়। এই ধরণের মানসিকতা তাদের কাজ না করে বসে থাকা থেকে বিরত রাখে এবং সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে।
নলেজ শেয়ারিং তত্ত্বঃ
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আসে নতুন উদ্ভাবন এবং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি উভয় দিক থেকেই আসে। একটি কোম্পানির কর্মচারীরা যখন তাদের মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি শেয়ার করে তখন তা উদ্যোক্তাদের নতুন সুযোগ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের নিজস্ব গোপনীয়তা রক্ষা করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সবার মাঝে উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত যেমন কোম্পানির সফলতার যাত্রা। যার ফলে নতুন উদ্যোক্তারা সাহস পাবে। যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বিস্তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মোট কথা, দেশের এবং সমাজের উন্নতির জন্য উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সঠিক সুন্দর পরিবেশ আমাদের তৈরি করতে হবে। তাদের জন্য অর্থ, দিক নির্দেশনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। দেশে স্থিতিশীল অবস্থা রাখতে হবে। যেন তরুণরা তাদের নতুন ধারণা নিয়ে ব্যবসা করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।
Comments