গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির
গৌতম আদানি বর্তমানে বিশ্বের ২১ তম ধনী ব্যক্তি। তার বর্তমান অর্থের পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন ডলার। মাঝে মাঝেই তিনি ভারতের আরেক ধনী মুকেশ আম্বানিকে পেছনে ফেলে এশিয়ার শীর্ষ ধনীর তকমা পেয়েছেন। এই ধনকুবের অধীনে আছে ভারতের ১৩ টি সমুদ্র বন্দর যার মধ্য দিয়ে ভারতের চার ভাগের এক ভাগ পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। এদিকে আদানি কোন ধনী পরিবারের সন্তান না। তাহলে কিভাবে তিনি এক প্রজন্মে এই পাহাড়সম সম্পদ গড়লেন?
গল্পের শুরু হয় ভারতের গুজরাট রাজ্যের আমদাবাদ শহরে। যেখানে জন্ম গ্রহণ করেন গৌতম আদানি। তবে আদানির পুরো নাম কিন্তু গৌতম শান্তিলাল আদানি। সাত ভাই বোনের পরিবারে আর্থিক টানাপড়েন লেগেই থাকতো। আদানির বাবার শাড়ি-কাপড়ের দোকান চালাতেন। আদানি স্কুল জীবন শেষ করেন আমদাবাদ শহরে। এরপর তিনি গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ২য় বছর শেষ হতে না হতেই তিনি ভাগ্য বদলের চিন্তায় স্বপ্নের নগরী মুম্বাই চলে আসেন। আদানি প্রথম মুম্বাইতে পা রাখেন ১৯৭৮ তে। সে সময় তার কাছে বলার মত কিছুই ছিল না।
কিন্তু আদানির চোখ সব সময় বড় কিছু করার ইচ্ছা ছিল। আদানিকে সে সময় ডায়মন্ড কাটিং এর কাজে প্রবেশ করান তারই চাচাতো ভাই। টানা তিন বছর কাজ করার সুবাদে আদানি ডায়মন্ড এর মার্কেট সম্পর্কে বুঝে গেছেন। সাল ১৯৮১, আদানি এবার নিজেই ডায়মন্ড ব্রোকার এর ব্যবসায় লেগে পরেন। ব্রোকার হিসেবে তার প্রথম ইনকাম ছিল ১০ হাজার টাকা। তিনি ব্যবসাকে এবার আরো বড় করবেন। এমন সময় আদানির বড় ভাই মনসুখ আদানি তাকে ফোন করেন। মনসুখ তার প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি জন্য সাহায্য চান। কিন্তু সে সময় পলিথিন তৈরির জন্য যে কাঁচামাল দরকার ছিল তার পর্যাপ্ত জোগান ছিল না ভারতে।
এই সুযোগ কাজে লাগান আদানি, তিনি নিজেই এবার বাহির থেকে প্লাস্টিকের কাঁচামাল কিনে পুরো ভারতে বিক্রি শুরু করেন। তবে সে সময় বাহির থেকে কিছু আমদানি করা এতটা সহজ ছিল না। এই সমস্যার সমাধান হয় যখন রাজিব গান্ধী ব্যবসায়িক দের জন্য আমদানি রপ্তানির আইন কানুন সহজ করে দেন। আদানি প্রথমবারের মত তার ট্রেডিং শুরু করেন।
১৯৮৮ এ আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠা করেন গৌতম আদানি। যার মাধ্যমে তিনি প্রবেশ করেন পণ্য ট্রেডিং ব্যবসায়, যেমন মধ্য প্রাচ্য থেকে তেল গ্যাস নিয়ে আসা। কিন্তু এই সমস্ত কিছু বাহির থেকে আমদানি করতে আদানি গ্রুপের অনেক টাকা কর প্রদান করতে হত। এই সমস্যা সমাধানে আদানি গুজরাট রাজ্য এক্সপোর্ট কর্পোরেশন থেকে সাহায্য চান। এই কোম্পানির সাথে মিলে আদানি গ্রুপ তাদের পণ্য আমদানি করতো যার ফলে তাদের এক টাকাও কর দিতে হতো না।
এই পদক্ষেপ আদানির জীবন বদলে দেয়, যেখানে তারা মাত্র ১০০ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করতো কিছুদিন তা দাঁড়ায় ৪০ হাজার মেট্রিক টনে। তবে এখন আর আদানি গ্রুপ শুধু প্লাস্টিক তৈরি কাঁচামাল আমদানি করে না সাথে সাথে পেট্রোলিয়ম পণ্যও আমদানি শুরু করে। পাশাপাশি আদানি বিরাট বড় ট্রেডিং হাউস শুরু করে। যেটা বড় ধরণের ইতিবাচক ধাক্কা পায়। তখন ভারত সরকার লিবারেলাইজেশন নীতি চালু করে। যার মাধ্যমে আদানি বিশ্বের অন্যান্য দেশের কোম্পানির সাথে কাজ করার সুযোগ পায়।
এর মাধ্যমেই আদানি প্রবেশ করেন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইন্ডাস্ট্রির দুনিয়ায়। কিন্তু এই ধরনের বিজনেসে প্রবেশ করতে চাইলে প্রয়োজন রাজনৈতিক ব্যক্তি দের সাথে ভালো সম্পর্ক। সেই সময় থেকে আদানি ভালো সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেন চামুন ভাই প্যাটেল এবং কেশু ভাই প্যাটেলের সাথে। পরবর্তীতে আদানি গ্রুপ হাত মিলায় কারগিল কোম্পানির সাথে বিদেশে লবণ রপ্তানির জন্য। কিন্তু এই বিশাল পরিমাণ লবণ রপ্তানির জন্য তাদের দরকার ছিল গভীর সমুদ্র বন্দর। যেখানে অন্যান্য দেশ থেকে আসা বড় বড় জাহাজ এসে পণ্য আনা নেওয়া করতে পারবে।
আদানির কাজের সাথে ভাগ্যও তার সঙ্গী হয়েছে। ঠিক সেই সময় ভারত সরকার দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ানোর জন্য সরকার নিয়ন্ত্রিত কিছু সমুদ্র বন্দর ব্যক্তি মালিকায় রূপান্তর করতে চায়। তারই সূত্র ধরে আদানি মুন্দ্রা সমুদ্র বন্দর কিনে নেয়। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় পুরো দমে নেমে পরেন। তার কাছের বন্ধুর বলেন যে আদানি মুন্দ্রা বন্দরকে খুব ভালোবাসেন কারণ ভারতে তার বিজনেস সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই।
তবে আদানি এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি তার মুন্দ্রা বন্দরের পাশে তৈরি করেন স্পেশাল ইকনোমিক জোন (ইপিজেড) তৈরি করেন। যেখানে দেশ বিদেশের অনেক কোম্পানি তাদের বিজনেস শুরু করেন। এই কোম্পানির পণ্য রপ্তানির জন্য মুন্দ্রা বন্দর ব্যবহার করতো। সেখান থেকেও ইনকাম হচ্ছিল আদানি গ্রুপের। সমুদ্র বন্দরের ব্যবসায় লাভের মুখ দেখায় আদানি ভারতের ১৩টি সমুদ্র বন্দর নিজের নামে করে নেয়। আর এই বন্দরের মধ্য দিয়েই ভারতের ৩০% কার্গো এবং ৪০% শিপিং কনটেইনার প্রবেশ করে। আর এর মাধ্যমেই বোঝা যায় বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসায় আদানির কতটা প্রভাব রয়েছে।
আদানি ধাপে ধাপে তার বিজনেসকে আগে বাড়িয়েছেন। (আদানির ইপিজেড) বেশ কিছু কয়লা ভিত্তিক কোম্পানি ছিল। সেখান থেকেই আদানি চিন্তাভাবনা করে নিজেই একটি তাপ ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেন। এরই সঙ্গেই আদানি গ্রুপের আগমন ঘটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবসায়। আদানির স্বপ্ন ছিল ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে আদানি গ্রুপ ৪৬২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভারতকে তাক লাগিয়ে দেয়।
আদানির এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অনেক কয়লার প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি ভাবলেন তিনি নিজেই কয়লা উৎপাদন করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আদানি নেমে পরলেন কয়লার খনির খোঁজে। আদানি কয়লা মাইনিং এর জন্য সাউথ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া বিনিয়োগ করে। এই কয়লা প্রক্রিয়াজাত করার পরে আদানী এন্টারপ্রাইজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। যেমন আদানী এন্টারপ্রাইজের ১৫% কয়লা যায় আদানি পাওয়ারের কাছে।
তবে আদানীর এই সফলতার পাশাপাশি কন্ট্রোভার্সি বা সমালোচনাও কম ছিল না। অনেকে বলে থাকে তার এই সফলতা হচ্ছে ক্রনিক ক্যাপিটালিজমের ফল। এটি এমন একটি তত্ত্ব যেখানে বলা হয় ব্যবসায়িক সফলতার পেছনের প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। ভারতের বিরোধী দলীয় নেতা বলেন আদানির সফলতার পেছনে হাত রয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি মূলত তার রাজ্য গুজরাটের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যই তিনি ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন।
সমুদ্র বন্দরের পরে গৌতম আদানির নজর পড়ে বিমান বন্দরের দিকে। ২০১৮ সালে ভারত তাদের কিছু বিমানবন্দর ৫০ সালের জন্য ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করতে চায়। যার ফলে জয়পুর, লখনউ, আহমেদাবাদ সহ বেশ কিছু বিমান বন্দরের নিয়ন্ত্রণ পায় আদানি গ্রুপ। কিছু দিনের মধ্যেই আদানি গুপ ভারতের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ কারক কোম্পানিতে পরিণত হয়।
তবে আদানি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা পান হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশের পর। যেখানে বলা হয়, আদানি স্টক নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করেন। আদানি গ্রুপের শেয়ার এমন সব কোম্পানি কিনে নিতো যারা অস্তিত্ব শুধু কাগজ কলমেই। যে কোম্পানি গুলো নিয়ন্ত্রণ করতো আদানি পরিবারের সদস্যরা। এই রিপোর্ট প্রকাশের পরে রাতা-রাতি আদানি বিশ্বের তৃতীয় তম ধনী ব্যক্তির তালিকা থেকে ২৭ নম্বরে নামেন।
এই ধাক্কাকে সামাল দিতে আদানি তার কোম্পানিরতে বিনিয়োগের জন্য বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানিকে নিয়ে আসেন। যার ফলে আদানি গ্রুপে তার নিজ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ কমে আসে। যার ফলে সাধারণ মানুষ এবং অন্যান্য বিনিয়োগ কোম্পানিও শক্তি পান আদানি গ্রুপে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে। তাই তিনি আবার তার কোম্পানির অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম হন।
আদানি যখনই কোনো বিজনেস শুরু করেন তিনি সেই বিজনেসের আসে পাশের সম্ভাবনার দিকে তাকান। যেমন, পলিথিন বানানোর জন্য প্লাস্টিকের আমদানির সংকট ছিল, আদানি ট্রেডিং বিজনেসের সাথে যুক্ত হয়ে যান। ট্রেডিং করার জন্য সমুদ্র বন্দরের দরকার ছিল তিনি বন্দর সম্পর্কিত ব্যবসায় যুক্ত হলেন। বন্দর এর ইনকাম বাড়ানোর জন্য ইপিজেড তৈরি করলেন। ইপিজেডে পাওয়ার সরবরাহ করার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেন। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করার জন্য কয়লার উত্তোলনের ব্যবসায় জড়িয়ে পরেন আদানি। এরপর বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণের ব্যবসায় নামেন আদানি।
সোনার একটি গহনা তৈরির আগে যেমন সোনাকে খুব তাপ দেওয়া হয় ঠিক তেমন ভাবে গৌতম আদানিকে জীবনে অনেক কষ্ট কঠিন পরীক্ষা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি জীবনের সবগুলো পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং নিজেকে নিয়ে গেছেন এক চরম উচ্চতায়। যার ফলে আজ গৌতম আদানির ব্যবসা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে
Comments