Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া |
চলুন একটি ভবিষ্যৎ কল্পনা করি, যেখানে হাতঘড়ি সময়ের সাথে সাথে আমাদের হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ এবং এমনকি সম্ভাব্য সকল স্বাস্থ্য ঝুঁকিও পর্যবেক্ষণ করে আমাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় জানিয়ে দিচ্ছে। এটি আসলে কোনো বিজ্ঞান কল্পকথা নয়; এটি হলো স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ওয়্যারেবল ডিভাইসগুলো থেকে পাওয়া বিশেষ সুবিধা।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ওয়্যারেবল ডিভাইস বলতে শরীরে সংযুক্ত এমন ডিভাইসকে বোঝায় যা রোগীর স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে চিকিৎসক, পদাধিকারী, বীমাকারী এবং অন্যান্য পক্ষ বিশ্লেষণ ও গবেষণার জন্য ব্যবহার করে। এই ডিভাইসগুলো, যেমন- স্মার্টওয়াচ, ফিটনেস ট্র্যাকার, রক্তচাপ মনিটর, বায়োসেন্সর, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) মনিটর এবং গ্লুকোজ মিটার দিয়ে সাধারণত দূরবর্তী রোগী পর্যবেক্ষণ এবং টেলিহেলথ সেবাগুলোতে ব্যবহৃত হয়। এর সাধারণ থিম হলো, এগুলো হৃদস্পন্দন, গ্লুকোজের মাত্রা এবং রক্তচাপের মতো জীবনচিহ্ন ট্র্যাক ও পর্যবেক্ষণ করে।
ওয়্যারেবল ডিভাইস এখন আর কেবল ফিটনেস ট্র্যাকার বা রক্তচাপ মনিটরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। ঐতিহ্যগতভাবে পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায়ই রোগী, পরিবার বা স্বামী-স্ত্রীদের কাছ থেকে প্রেরিত তথ্যের উপর নির্ভর করে, যা রোগ নির্ণয়ে অসঙ্গতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে এই ডিভাইসগুলো বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যেখানে প্রতিটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন রোগের তীব্রতার ইঙ্গিত দিতে পারে। সমন্বিত স্বাস্থ্য সেন্সরের সাহায্যে এই ডিভাইসগুলো সম্পূর্ণ দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ দেয়।
ওয়্যারেবল ডিভাইসগুলোর উপকারিতা
ওয়্যারেবল ডিভাইসগুলো, যেমন- স্মার্টওয়াচ এবং ফিটনেস ট্র্যাকার, স্বাস্থ্যসেবা খাতে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় বহু মানুষকেই দূরবর্তী অবস্থানরত ডাক্তারের নিকট হতে স্বাস্থ্যসেবা সেবা নিতে হয়েছিল। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের এমন পরিবর্তন বেশ ইতিবাচক প্রভাবই ফেলেছে।
স্মার্টওয়াচ এবং ফিটনেস ট্র্যাকারের মতো ওয়্যারেবল ডিভাইসগুলো বর্তমানে আরও উন্নত হয়েছে। যা আপনার শরীরের বেশ কিছু গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেই আপনার হার্ট রেট, রক্তচাপ, ঘুমের প্যাটার্ন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত কোনো ঝুঁকিপুর্ণ বিষয় আগাম জানিয়ে দিতে পারে। এমনকি এই ডিভাইসগুলি দূর থেকে স্বাস্থ্য অবস্থার উন্নতি বা বর্তমান অবস্থাও ট্র্যাক করতে পারে। কোভিড মহামারী এই প্রযুক্তির বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে এবং আগামী বছরগুলোতেও এর ব্যবহার আরো ব্যাপক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়াও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এই ওয়্যারেবল ডিভাইসগুলো দিয়ে- স্বাস্থ্যের অবস্থা সর্বদা পর্যবেক্ষণে রাখা, স্বাস্থ্যসেবার উদ্দেশ্যে ডেটা অ্যাক্সেস বাড়ানো, সম্ভাব্য সকল স্বাস্থ্য সমস্যা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিকারের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবায় খরচ কমানো ইত্যাদি সুবিধা পাওয়া সম্ভব।
স্বাস্থ্যসেবায় শীর্ষ ৫টি ওয়্যারেবল ডিভাইস
১। রক্তচাপ মনিটরঃ
রক্তচাপ মনিটর হল একটি ডিভাইস যা রক্তচাপ পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়। এটিতে আপনার হৃৎপিণ্ডের তথ্য দুটি সংখ্যায় দেখাবে- সিস্টোলিক চাপ (আপনার হৃদ স্পন্দন করার সময় চাপ) এবং ডায়াস্টোলিক চাপ (আপনার হৃদ স্পন্দনের মধ্যে বিশ্রামের সময় চাপ)। এটি ব্যবহার করে রক্তচাপ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে আপনি উচ্চ রক্তচাপের মতো সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সমস্যা চিহ্নিত এবং পরিচালনা করতে সাহায্য করতে পারেন।
২। গ্লুকোজ মনিটরিং ডিভাইস
গ্লুকোজ মনিটরিং ডিভাইস একটি ওয়্যারেবল ডিভাইস যা ক্রমাগত আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা ট্র্যাক করে। এটি একটি ছোট সেন্সরের মতো যা আপনি আপনার বাহুতে আটকাতে পারেন এবং এটি রিয়েল-টাইম ডেটা আপনার স্মার্টফোনে পাঠায়।
এই ডিভাইসটি আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি বা খুব কম হলে আপনাকে সতর্ক করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপযোগী কারণ এটি ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করে এবং ঘন ঘন আঙুল ছিদ্র করার প্রয়োজনীয়তা কমায়।
৩। ওয়্যারেবল ইসিজি মনিটর
ওয়্যারেবল ইসিজি মনিটর হলো এমন একটি ডিভাইস যা শরীরে পরা যায় এবং হৃদয়ের কার্যকলাপ ক্রমাগত ট্র্যাক করে। এই ডিভাইসগুলো অ্যাপল ওয়াচের মতো স্মার্টওয়াচের সাথে সংহত করা যায় অথবা কার্ডিয়ামোবাইলের মতো স্বতন্ত্র ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। হৃদস্পন্দন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই ডিভাইসগুলো সম্ভাব্য হৃদরোগের সমস্যা প্রথম দিকেই সনাক্ত করতে পারে। রোগীরা সহজেই রেকর্ড করা ডেটা চিকিৎসকদের সাথে বিশ্লেষণ ও রোগ নির্ণয়ের জন্য শেয়ার করতে পারে।
৪। ফিটনেস ট্র্যাকার
ফিটনেস ট্র্যাকার হল ওয়্যারেবল ডিভাইস যা আপনার শারীরিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে সাহায্য করে। এগুলো সেন্সর ব্যবহার করে আপনার হৃদস্পন্দন, ক্যালোরি বার্ন, পদক্ষেপ এবং ঘুমের নিদর্শন ট্র্যাক করে। ফিটনেস ট্র্যাকার পরার মাধ্যমে আপনি আপনার ওয়ার্কআউট এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক পেতে পারেন।
অনেক ফিটনেস ট্র্যাকারই স্মার্টফোন অ্যাপের সাথে সিঙ্ক করে, জিপিএস ট্র্যাকিং এবং জলরোধীতার মতো অতিরিক্ত ফিচার প্রদান করে। এই ফিচারগুলো আপনাকে আপনার অগ্রগতি ট্র্যাক করতে, ফিটনেস লক্ষ্য নির্ধারণ করতে এবং আপনার জীবনধারা সম্পর্কে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
৫। ইন্টিগ্রেটেড অ্যাক্টিভওয়্যার
ইন্টিগ্রেটেড অ্যাক্টিভওয়্যার হল ফিটনেস ইন্ডাস্ট্রির একটি নতুন প্রবণতা যা ফ্যাশন ও প্রযুক্তিকে একত্রিত করে। এই পোশাকগুলো বিভিন্ন স্বাস্থ্য মেট্রিক্স পর্যবেক্ষণ এবং রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক প্রদানের জন্য তাদের ফ্যাব্রিক এ ক্ষুদ্র সেন্সর সংযুক্ত করে।
উদাহরণস্বরূপ- একটি স্মার্ট শার্ট হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের নিদর্শন ট্র্যাক করতে পারে, যখন স্মার্ট জুতা পায়ের চাপ ও গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে পারে। পোশাকে প্রযুক্তি সংহত করার মাধ্যমে অ্যাথলেট ও ফিটনেস উৎসাহীরা তাদের পারফরম্যান্স অপ্টিমাইজ করতে, আঘাত প্রতিরোধ করতে এবং তাদের সামগ্রিক সুস্থতা উন্নত করতে পারে।
এছাড়াও স্মার্ট হেলথ ওয়াচ, ইলেক্ট্রনিক স্কিন প্যাচ, হাইড্রেশন এবং সোয়েট সেন্সর, প্রেগ্নেন্সি এন্ড নিউবর্ন বেবি মনিটর ও স্মার্ট কন্টাক্ট লেন্সও আজকাল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবায় ওয়্যারেবল ডিভাইসগুলো যেসব অসমীচীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে
ওয়্যারেবল এসব প্রযুক্তি স্বাস্থ্যকর জীবনধারার দিকে প্রাকৃতিক পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। যদিও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ওয়্যারেবল এই ডিভাইসগুলো অতি উপকারি হলেও বর্তমানে একটি প্রধান উদ্বেগ হলো ডেটার গোপনীয়তা রক্ষা। কারণ এই ডিভাইসগুলো সংবেদনশীল স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ করে। অননুমোদিত অ্যাক্সেস ও অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য এই ডাটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অতিরিক্তভাবে, ওয়্যারেবল ডিভাইস দ্বারা সংগৃহীত ডেটার নির্ভুলতা ও নির্ভরযোগ্যতা পরিবর্তনশীল হতে পারে, যা চিকিৎসাগত সিদ্ধান্তের নির্ভুলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ডিভাইসগুলোর মূল্য বেশি হওয়ায়, এগুলো বিশেষ করে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবহার করা কিছুটা কঠিন হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় ওয়্যারেবল ডিভাইসগুলির সুবিধা সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানোর জন্য এই সমস্যাগুলি সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভবিষ্যতে এই ডিভাইসগুলো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি প্রথম পর্যায়েই সনাক্ত এবং প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রযুক্তি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে, আমরা আরও অত্যাধুনিক ওয়্যারেবল ডিভাইস দেখতে পাব যা স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটাতে পারে।
Comments