Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তায়্যিবা |
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে আমাদের চারপাশের সবকিছু খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও যা ভাবা কষ্টসাধ্য ছিলো তা আজ একেবারে হাতের নাগালে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা প্রযুক্তির এই অভাবনীয় দ্রুত অগ্রগতি আমাদের সামনে কিছু চমকপ্রদ বিষয়ও তুলে ধরেছে। আদৌও কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে থেকে কিছু শিখতে সক্ষম? তাও আবার ভাষার মত জটিল একটি বিষয়। গতবছর গুগলের এআই মডেল জেমিনাই (আগের নাম বার্ড) নিজে থেকেই বাংলা ভাষা শিখেছে বলে একটি দাবি সামনে এসেছে, যা এআই বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এটি সত্যিই সম্ভব যে একটি এআই নিজে নিজে ভাষা শিখতে পারে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
গুগলের দাবি বনাম জেমিনাই -এর বাংলা দক্ষতা
সিবিএস নিউজের-এর ‘৬০ মিনিটস’ শোতে এক সাক্ষাৎকারে, গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই ও প্রতিষ্ঠানটির প্রযুক্তি নির্বাহী জেমস মনিয়িকা দাবি করেন যে তাদের এআই মডেল, জেমিনাই নামমাত্র নির্দেশেই ( যাকে বলা হয় প্রম্পট) বাংলা অনুবাদ করতে এবং বুঝতে সক্ষম হয়েছে। সিইও সুন্দর পিচাই এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে এটিকে এআই-এর উদীয়মান বৈশিষ্ট্য (ইমারজেন্ট প্রপার্টিস) হিসেবে উল্লেখ করেন।
এদিকে জেমিনাই নিজে থেকেই বাংলা শিখেছে— গুগলের এমন দাবি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে থেকে শিখতে পারে তা এখনো এআই গবেষণায় সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।
রহস্যের উন্মোচনঃ যা জানালো বিজ্ঞানীরা
গুগলের এই দাবির বিরুদ্ধে দ্রুতই এআই বিশেষজ্ঞরা আপত্তি জানান। গুগলের সাবেক গবেষক মার্গারেট মিচেল বলেন গুগলের আগের এআই মডেল পাম (PaLM)- বার্ড বা জেমিনাই তৈরির আগেই বিপুল পরিমাণ বাংলা ডাটা সেট দ্বারা প্রশিক্ষিত হয়েছিল। অর্থাৎ, বার্ডের বাংলা জ্ঞানের পেছনে স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষার কোনো ভূমিকা ছিল না, বরং এটি মূলত আগের প্রশিক্ষিত ডেটার ফল।
এআই গবেষকদের মতে, যা স্ব-শিক্ষা বলে মনে হচ্ছে, তা আসলে নিছক প্যাটার্ন মাত্র, যা বার্ড বা জেমিনাই যাই বলি না কেন, তার আগের মেশিন লার্নিং মডেল থেকে ধার নিয়েছে। বড় ভাষার মডেল (লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল) যেমন জেমিনাই বা চ্যাটজিপিটি বহুভাষী বিশাল ডেটাসেটে প্রশিক্ষিত হয়। যখন কোনো এআই-কে বাংলা ভাষায় কোনো প্রম্পট দেওয়া হয়, তখন এটি তার আগের শেখা তথ্য থেকে উত্তর তৈরি করে তবে নতুন ভাষা নিজের মতো করে শিখে ফেলে না।
এআই-এর ব্ল্যাক বক্স
এআই উন্নয়নের সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর দিকগুলোর একটি হলো তথাকথিত ব্ল্যাক বক্স, অর্থাৎ অজানা কিছু। মাঝে মধ্যে এআই নির্মাতারাও বুঝে উঠতে পারেন না যে তাদের মডেল কেন এবং কীভাবে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসে। সিইও সুন্দর পিচাই নিজেও স্বীকার করেছেন যে কখনো কখনো এআই এমন ফলাফল তৈরি করে যা ব্যাখ্যা করা আদতে বেশ কঠিন।
একটি এআই কি সত্যিই নিজে নিজে শিখতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই সিস্টেমগুলো প্রায় সময় অপ্রত্যাশিত আচরণ প্রদর্শন করলেও, এগুলো মানব মস্তিষ্কের মতো শিখতে পারে না। মানুষ অভিজ্ঞতা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমে ভাষা শেখে, কিন্তু এআই কেবল পরিসংখ্যানগত প্যাটার্ন এবং আগের ডাটার উপর নির্ভরশীল। যা “স্বশিক্ষা” বলে মনে হলেও তা আসলে নয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ: কী অপেক্ষা করছে সামনে?
জেমিনাই, চ্যাটজিপিটি এবং মাইক্রোসফটের এআই টুলগুলোর দ্রুত উন্নয়ন ইঙ্গিত দেয় যে আমরা একটি নতুন প্রযুক্তিগত যুগে প্রবেশ করছি । যদিও এই সিস্টেমগুলো মানবসদৃশ আচরণ প্রক্রিয়াকরণে অত্যন্ত দক্ষ, তবে এগুলো এখনো সম্পূর্ণভাবে মানবিক বোধশক্তির সমতুল্য নয়। তবে ভবিষ্যতে এআই-এর স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উচিত তাদের মডেলের প্রকৃত সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা, যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার বা শঙ্কা এড়ানো যায়। বর্তমান যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি শক্তিশালী টুল, তবে এটি এখনো সত্যিকারের স্বনির্ভর শিক্ষার পর্যায়ে পৌঁছায়নি—এবং খুব দ্রুতই এটি মানবিক বোধবুদ্ধি ও যুক্তির প্রতিস্থাপন করবে তাও সম্ভব নয় বলে ধারণা করছেনে এআই বিশ্লেষকরা।
Comments