বিসনেস স্ট্রাটেজিস

ড. ইউনুসের নতুন বিশ্বঃ এ ওয়ার্ল্ড অফ থ্রি জিরোস

0
ছবি: সংগৃহীত
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তায়্যিবা

পৃথিবীটা কেমন হতো যদি বিশ্বব্যাপী দরিদ্রতা, বেকারত্ব এবং কার্বন নির্গমন এই তিনটি  সমস্যার সমাধান হয়ে যেত? এমনি একটি নতুন অর্থনৈতিক মডেল প্রস্তাব করেছেন  শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে তিনি একটি নতুন ধারণা তুলে ধরেছেন, যার নাম দিয়েছেন ” এ ওয়ার্ল্ড অফ থ্রি জিরোস “।

ড. মুহাম্মদ ইউনুস তাঁর বই  “এ ওয়ার্ল্ড অফ থ্রি জিরোস: দ্য নিউ ইকোনমিক্স অফ জিরো পভার্টি, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড জিরো নেট কার্বন এমিশন” – এ নতুন এক অর্থনৈতিক মডেল উপস্থাপন করেছেন । তাঁর এই নতুন মডেল মূলত তিনটি প্রধান বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নির্গমন। তাঁর মতে,, বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বের সমস্যাগুলির সমাধান করতে সক্ষম নয়, বরং এটি মুনাফাকেন্দ্রিক হওয়ায় বিরূপভাবে আয় বৈষম্য এবং সামাজিক অসমতা তৈরি করে। তাই, বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন নির্গমনের সমস্যা সমাধানের নীতি গ্রহণ করতে হবে। 

ডঃ ইউনূসের নতুন বিশ্ব: তিন জিরোর বিশ্ব, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন নির্গমন দূর করার জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।

‘ওয়ার্ল্ড অফ থ্রি জিরোস’-এর জন্য ড. ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গি। | ছবি: সংগৃহীত

. শূন্য দারিদ্র্য (জিরো পভার্টি)

বইটির প্রথম “শূন্য” হলো শূন্য দারিদ্র্য। ড. ইউনুসের মতে, দরিদ্রতা কেবল অর্থের অভাব নয়, এটি ক্ষমতার অভাব, সুযোগের অভাব এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে একটি বিশাল বৈষম্য তৈরি করে। এই ব্যবস্থায় ধনীরা আরও ধনী হয়, আর দরিদ্ররা আরও অসহায় হয়ে পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের শীর্ষ ১% ধনী ব্যক্তিরা মোট সম্পদের ৪৩% এর মালিক। এদিকে, ২০২৩ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জানায় যে বিশ্বব্যাপী ২৪১ মিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে, যাদের দৈনিক আয় ২.১৫ মার্কিন ডলারের কম। এমন অসম সম্পদের বণ্টন দরিদ্রতা বৃদ্ধি করে এবং সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। ড. ইউনুস মনে করেন, দরিদ্রতা দূর করার জন্য দরিদ্রদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন, যা সমাজে সমান সুযোগ সৃষ্টি করবে। 

এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, তিনি **”সোশ্যাল বিজনেস”** নামক একটি ব্যবসায়িক মডেলের প্রস্তাব দেন।  এই মডেলে ব্যবসার উদ্দেশ্য মুনাফা নয়, বরং সামাজিক সমস্যার সমাধান করা। এখানে অর্জিত মুনাফা ব্যবসায় পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়, যার ফলে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি এমন একটি মডেল যেখানে মুনাফা অর্জনের পরিবর্তে সামাজিক সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেওয়া হয়। এই ধরনের ব্যবসায়ের লাভ পুনরায় ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়, যা সমাজের জন্য কল্যাণকর। সোশ্যাল বিজনেসের মাধ্যমে দরিদ্ররা স্বনির্ভর হতে পারে এবং দরিদ্রতার চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে।

. শূন্য বেকারত্ব (জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট)-

বইটির দ্বিতীয় “শূন্য” হলো শূন্য বেকারত্ব। ড. ইউনুসের মতে, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সবার জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে যুবসমাজ এবং দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ বেকারত্বের শিকার হয়। ২০২৩ সালে, বিশ্বব্যাপী বেকারত্বের হার প্রায় ৪.৯৬%, যা প্রায় ৩৯৬.৮ মিলিয়ন বেকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশে সেই একই বছরে বেকারত্বের হার প্রায় ৫.০৬%, যা ৩.৫ মিলিয়ন মানুষের সমান। ড. ইউনুস বিশ্বাস করেন, প্রতিটি মানুষ উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রাখে যদি তাকে সুযোগ দেওয়া হয়। তিনি প্রস্তাব দেন যে সোশ্যাল বিজনেস এবং মাইক্রোক্রেডিট মডেলের মাধ্যমে দরিদ্র ও বেকার মানুষ নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে পারে এবং নিজেদের ও অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে। এতে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের সমস্যা একসঙ্গে সমাধান করা সম্ভব হবে।

. শূন্য নেট কার্বন নির্গমন (জিরো নেট কার্বন এমিশন)-

বইটির তৃতীয় এবং শেষ “শূন্য” হলো শূন্য কার্বন নিঃসরণ। ড. ইউনুস মনে করেন, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার করছে, যার ফলে কার্বন নির্গমন বেড়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানব সভ্যতা হুমকির মুখে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন ছিল ৪০.৯ বিলিয়ন মেট্রিক টন। ১৮৮০ সাল থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অন্তত ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।

ড. ইউনুস মনে করেন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে কার্বন নির্গমন কমানো সম্ভব।  একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে কার্বন নির্গমন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই উদ্দেশ্য অর্জনে শিল্প উৎপাদনে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝোঁক বাড়াতে হবে।

জিরো নেট কার্বন নির্গমন: ড. ইউনূসের নিউ ওয়ার্ল্ড ভিশনের একটি মূল দিক যার লক্ষ্য স্থায়িত্ব এবং পরিবেশগত দায়িত্ব প্রচার করা।

ডঃ ইউনূসের নিউ ওয়ার্ল্ড ভিশনে শূন্য নেট কার্বন নির্গমন। | ছবি: সংগৃহীত

এক্ষেত্রে চারটি প্রয়োজনীয় উপাদান-

ড. ইউনুসের “তিনটি শূন্যের বিশ্ব” মডেল বাস্তবায়নের জন্য তিনি চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন-

১. তরুণদের শক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানো,

২. প্রযুক্তির ক্ষমতা ব্যবহার করা,

৩. ব্যবসাকে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তর করা এবং

৪. সুশাসন নিশ্চিত করা।

তার মতে, সুশাসনই এই পুরো প্রক্রিয়ার ভিত্তি। আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার এবং স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ শাসন ব্যবস্থা না থাকলে এই মডেল সফল হতে পারবে না। তাই সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে “তিনটি শূন্য” ধারণা বাস্তবায়িত হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ” এ ওয়ার্ল্ড অফ থ্রি জিরোস” এই তত্ত্ব আমাদেরকে একটি সমতাভিত্তিক ও টেকসই বিশ্ব গড়ার অনুপ্রেরণা দেয়। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে দরিদ্রতা, বেকারত্ব, এবং পরিবেশগত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাই তাঁর মতে, প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়নের পথ তৈরি করতে হবে।

“তথ্যসূত্র”

বিলিওনিয়ার জেফ বেজোসের সফলতার গল্প: গ্যারেজ থেকে বিশ্বজয়ের কাহিনী

Previous article

শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরী অর্থ ব্যবস্থাপনা

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *