Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার |
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে । বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক সবুজ কারখানার পাশাপাশি টেকসই উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী নেতা হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব হয়েছে। এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন শুধু টেক্সটাইল উৎপাদনের জন্য পরিবেশ-বান্ধব হাব হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেনি বরং দেশের অর্থনীতি, কর্মশক্তি এবং পরিবেশের জন্য অনেক বেশি সুযোগ- সুবিধার সৃষ্টি করেছে। চলুন আজকে আমরা বাংলাদেশের এই ‘সবুজ ইন্ডাস্ট্রি’ নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
সবুজ আরএমজি কারখানা
সবুজ আরএমজি কারখানা বলতে মূলত পরিবেশ বান্ধব কারখানা নির্মাণ, নবায়নযোগ্য শক্তি গ্রহণ, পানির ব্যবহার কমানো এবং টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করারকে বোঝানো হয়। ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২২৬টিরও বেশি এলইইডি -প্রত্যয়িত কারখানা রয়েছে। এই কারখানাগুলো ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল(ইউএসজিবিসি) দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছে।
প্রেক্ষাপট
২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরিন ফ্যাশনসে অগ্নিকান্ডের ঘটনা এবং ২০১৩ সালের মর্মান্তিক রানা প্লাজা ধসের পর এই সবুজ রূপান্তর শুরু হয়েছিলো। মূলত ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতে দুর্বল শ্রম অধিকার এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবের কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স (জিএসপি) স্ট্যাটাস স্থগিত করেছিলো।
ঠিক তখনই ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকার খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলি গার্মেন্টস সেক্টরে আগুন, কাঠামোগত এবং বৈদ্যুতিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে ত্রুটিগুলি পরিদর্শন, সুপারিশ এবং প্রতিকারের জন্য বাংলাদেশে ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি গঠন করেছে। তারপর থেকে যাত্রা শুরু নতুন দিগন্তের। যেখানে উন্নত নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত মানের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো। বাংলাদেশী নির্মাতারা কেবল কাজের অবস্থার উন্নতিই করেনি বরং বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতামূলক স্থানও অর্জন করেছে। চলুন আমরা কয়েকটি সবুজ পোশাক কারখানা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
নাসা হাইটেক স্টাইল লিমিটেড
নাসা হাইটেক স্টাইল লিমিটেড জুলাই ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে। সবুজ কারখানাটি গাজীপুরে অবস্থিত। প্রথম থেকেই, এই কোম্পানিটি ইউএসজিবিসি দ্বারা প্রত্যয়িত হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং ২০১৯ সালে এলইইডি গোল্ড প্রশংসাপত্র অর্জন করেছে। কোম্পানিটি বেসলাইন পারফরম্যান্স রেটিংয়ে ৬% শক্তি খরচ কমিয়েছে। গ্রিন ফ্যাক্টরিটির অভ্যন্তরীণ কাজের জন্য ৪০% জল ব্যবহার হ্রাস করেছে এ্রবং বর্জ্য হ্রাস করেছে ৫০%। এই কোম্পানির সবুজ শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় নতুন ভবন নির্মাণ, ফ্যাব্রিকেশন এবং এলইইডি রেজিস্ট্রেশন, সার্টিফিকেশন এবং কনসালটেন্সি ফি হিসাবে খরচ ১৮% থেকে ২০ % পর্যন্ত বাড়িয়েছে। গ্রীন প্রজেক্টের কাজ শুরু করার পর, বিদ্যুতের ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেশিনের দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইনভয় টেক্সটাইল লিমিটেড (ইটিএল)
ইনভয় টেক্সটাইল লিমিটেড হল বিশ্বের প্রথম স্কোরকারী এলইইডি সার্টিফাইড প্লাটিনাম ডেনিম ফ্যাক্টরি। এটি ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৮ সালের প্রথম দিকে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। কারখানাটি ময়মনসিংহের ভালুকা জমিন্দিয়াতে অবস্থিত। ইনভয় টেক্সটাইল লিমিটেড শক্তি এবং পরিবেশ ডিজাইনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সুপরিচিত। ইটিএল ম্যানেজমেন্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল কম শক্তি এবং কম জল খরচসহ একটি সবুজ কারখানা স্থাপন করা। ইটিএল ২৯% শক্তি খরচ এবং ৩৪% জল খরচ হ্রাস করেছে। একইসঙ্গে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ৯৫% বর্জ্য উৎপাদন করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ১00% ব্যবহার নিশ্চিত করে।
বে ক্রিয়েশনস লিমিটেড
বে ক্রিয়েশনস লিমিটেড গত ১৪ বছর ধরে নিটিং গার্মেন্টস তৈরি ও রপ্তানি করার ক্ষেত্রে একটি বিখ্যাত নাম। এটি নারায়নগঞ্জে অবস্থিত। কোম্পানিটি এলইইডি গোল্ড ক্যাটাগরির সার্টিফিকেশন অর্জন করেছে। বে ক্রিয়েশন লিমিটেডের গ্রিন বিল্ডিং প্রকল্পটি ছিল একটি নতুন নির্মাণ প্রকল্প। এই বিল্ডিং নির্মাণের জন্য ১০% রি-সাইকেল কন্টেন্ট, ২০% আঞ্চলিকভাবে নিষ্কাশিত, পুনরুদ্ধার বা তৈরি সামগ্রী ব্যবহার করেছে। সবুজ কারখানাটি ল্যান্ডস্কেপ ওয়াটারিং এর জন্য ১০০% জলের ব্যবহার কমিয়েছে, ৪০% বেসলাইন ইনডোর জল খরচ এবং ৫০% বর্জ্য জল উৎপাদন কমিয়েছে।
এসএম সোর্সিং
এলইইডি তালিকায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পয়েন্টপ্রাপ্ত সবুজ পোশাক কারখানা এসএম সোর্সিং যা গাজীপুরের কোনাবাড়িতে অবস্থিত। এলইইডি রেটিং সিস্টেমে ১১০ পয়েন্টের মধ্যে কোম্পানিটি ১০৬ স্কোর করেছে। প্রায় চার বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি ভিতরে এবং বাইরে বিশুদ্ধ বাতাসের অবাধ প্রবাহের সুবিধার্থে ৩৫ শতাংশ জায়গা খোলা রেখে গাছ লাগানো হয়েছে। কারখানাটি সৌর প্যানেল থেকে প্রতিদিন ৪৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। এসএম সোর্সিং প্রতি বছর ২০০০ টন কার্বন নিঃসরণ রোধ করে যা প্রায় ৬৭,০০০ গাছ লাগানোর সমান।
একটি প্ল্যাটিনাম-রেটেড এলইইডি –প্রত্যয়িত ইউনিট তৈরি করতে খরচ একটি সাধারণ কারখানা তৈরির খরচের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।কিন্তু অতিরিক্ত খরচ সত্ত্বেও, বাংলাদেশের বেশ কিছু সংখ্যক উদ্যোক্তা তাদের কারখানাগুলোকে গ্রীন ইউনিটে রূপান্তরিত করেছে যাতে তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলিকে বৈশ্বিক মানের উপযোগী করা যায়। বাংলাদেশ অবশেষে চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হয়ে উঠেছে এবং বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্য অঙ্গনে ৭.৯ শতাংশ দখল করেছে। সবুজায়নের উদ্যোগ এই খাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সাহায্য করেছে।
Comments