Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া |
গ্রামীণফোন (জিপি), বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান, যার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সাল থেকে। টেলিযোগাযোগ খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে, তাদের কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব (সি এস আর ) কার্যক্রমের মাধ্যমে। গ্রামীণফোনের সি এস আর প্রচেষ্টা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে।গ্রামীণফোনের এই কর্মকাণ্ড সমাজে ব্যাপক প্রভাব রাখছে এবং জনমানুষের জীবনযাত্রা উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে।
সংযোগের মাধ্যমে জীবনের পরিবর্তন
গ্রামীণফোনের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল একটি অনন্য প্রকল্প দিয়ে, যেটি ছিল ভিলেজ ফোন প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করার সুযোগ পায়। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে তারা ফোন কিনে স্থানীয় মানুষের জন্য সেবা প্রদান করত। এর ফলে নারীরা নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৭০,০০০ নারী এই প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন।
এছাড়াও, তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে ২০০৬ সালে চালু হয়েছিল কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টার (সি আই সি )। সি আই সি -এর মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, প্রিন্টিং এবং ভিডিও কনফারেন্সিং সুবিধা দেওয়া হয়। এসব কেন্দ্র স্থানীয় উদ্যোক্তারা পরিচালনা করেন, যা নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি করে। ২০২১ সালের মধ্যে সারা দেশে ৫০০ এরও বেশি সি আই সি স্থাপন করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম
গ্রামীণফোন বিভিন্ন স্বাস্থ্য কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য সেবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
১. সেফ মাদারহুড এবং ইনফ্যান্ট কেয়ার প্রোগ্রাম
২০০৭ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৯ লক্ষ গরীব মা এবং শিশু স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন। মোবাইল হাসপাতালের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় সেবা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
২. বিনামূল্যের চোখের চিকিৎসা শিবির
সাইটসেভার্স ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে অংশীদারিত্বে পরিচালিত শিবিরে প্রায় ১৯,০০০ মানুষ বিনামূল্যে চোখের চিকিৎসা পেয়েছেন এবং ২,২০০-এর বেশি মানুষের ক্যাটারেক্ট সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে।
৩. ন্যাশনাল ইমিউনিজেশন ডে (এন আই ডি ) ক্যাম্পেইন
টিকাদান প্রচারাভিযানের মাধ্যমে শিশুদের টিকাদানে সচেতনতা বাড়াতে এসএমএস এবং মিডিয়া প্রচার ব্যবহার করা হয়েছে।
৪. হেলথলাইন প্রকল্প
একটি ২৪ ঘণ্টার মোবাইল চিকিৎসা পরামর্শ সেবা, যা শহর এবং গ্রামে সাধারণ চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান করে। ২০০৬ থেকে ৩৫ লক্ষের বেশি মানুষ এই সেবা পেয়েছেন।
শিক্ষার প্রসার এবং ডিজিটাল ভবিষ্যতের নির্মাণ
শিক্ষা খাতে গ্রামীণফোনের সি এস আর কার্যক্রম তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিচায়ক।
১. অনলাইন স্কুল প্রকল্প
এই প্রকল্পে শহরের শিক্ষকরা ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেন। প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত এই সেবা গ্রহণ করেছে।
২. গ্রামীণ শিক্ষা স্কলারশিপ প্রোগ্রাম
অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বাৎসরিক বৃত্তি প্রদান করা হয়, যার ৬০ শতাংশ মেয়েদের জন্য বরাদ্দ।
৩. আলোকদীপ প্রকল্প
ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর গড়ে ওঠা এই প্রকল্পে স্কুল এবং আশ্রয়কেন্দ্র উভয়ের কাজ করা হয়, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয় প্রদান করে।
বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে জিপি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র এর বই বিতরণ কার্যক্রমেও সহায়তা করে।
পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নে পদক্ষেপ
পরিবেশ রক্ষায় গ্রামীণফোনের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রোগ্রাম
২০০৮ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচি সৌর এবং বায়ু বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা এবং কার্বন নির্গমন হ্রাসের জন্য কাজ করছে।
২. ক্লিক গ্রিন প্রোগ্রাম
কর্মীদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে এবং দায়িত্বশীল সম্পদ ব্যবহারে উৎসাহিত করে এই প্রকল্প।
৩. কমিউনিটি পাওয়ার প্রজেক্ট
বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন এলাকায় সৌর প্যানেল এবং বায়ু বিদ্যুৎ স্থাপন করার মাধ্যমে জ্বালানির টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন
গ্রামীণফোনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো:
১. অ্যাসিড সাপোর্ট প্রোগ্রাম
অ্যাসিড আক্রমণের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
২. স্পেশাল অলিম্পিক প্রোগ্রাম
বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশগ্রহণে সহায়তা প্রদান করেছে।
৩. ইনফরমেশন বোট প্রকল্প
নদী অঞ্চলের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য নৌকাকে তথ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রযুক্তি
গ্রামীণফোন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে:
১. সেলবাজার প্রোগ্রাম
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পণ্য কেনা-বেচার সহজ মাধ্যম তৈরি করেছে সেলবাজার।
২. কৃষি সেবা প্রোগ্রাম
কৃষকদের কৃষি পরামর্শ দিতে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সারা দেশে এই উদ্যোগ চালু করা হয়েছে।
গ্রামীণফোনের সি এস আর কার্যক্রম বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিবেশের উন্নয়নে তাদের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। যদিও তারা ইতিমধ্যে সমাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে, আরও বেশি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য তাদের সেবার পরিধি এবং মান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
এমন দায়িত্বশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণফোন ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আরও বৃহৎ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। গ্রামীনফোন এর পাশাপাশি অন্যান্য কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গঠনমূলক সি এস আর কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যবসার পাশাপাশি জনগণকে সেবা প্রদান করে নিজেদের ব্র্যান্ডভ্যালু অক্ষুণ্ণ রেখে বাংলাদেশকে স্মার্ট ও ডিজিটাল করবে এ আশা ব্যক্ত করা যায়।
Comments