Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার |
মরুভূমিতে বন্যা, সৌদি আরবে তুষারপাত কিংবা বাংলাদেশে হিটওয়েব সহ নানা ধরনের জলবায়ুর পরিবর্তন আমরা বর্তমান সময়ে দেখতে পাচ্ছি। একইসাথে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির তীব্র সংকট এবং পরিবেশের বিপর্যয় ও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই চরম সংকটের সময় মানুষ সবুজ শক্তির দিকে ঝুঁকছে। সবুজ শক্তি একইসাথে পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়ার জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ইতোমধ্যেই সবুজ শক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়া শুরু করেছে। আজকে আমরা এই সবুজ শক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
সবুজ শক্তি কি?
সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জি বলতে এমন শক্তিকে বোঝানো হয় যা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া যায়। সবুজ শক্তিকে প্রায়শই পরিচ্ছন্ন, টেকসই বা নবায়নযোগ্য শক্তি বলা হয়। সবুজ শক্তির উৎপাদন বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস মুক্ত করে না। অর্থাৎ, এটি পরিবেশের উপর কোনো বিরুপ প্রভাব ফেলে না। সবুজ শক্তি মূলত ১০০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া যায়, যার কারণে এটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না এবং দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সবুজ শক্তির প্রকারভেদ
সবুজ শক্তি নানা ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- সৌর শক্তি, বায়োমাস, জল বিদ্যুৎ, ফুয়েল সেল, ভূ-তাপীয় শক্তি, বায়ো-ফুয়েল, বায়ু শক্তি ইত্যাদি। নিচে আমরা কয়েকটি সবুজ শক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
সৌর শক্তি
সৌর প্যানেলগুলো সূর্যের আলোকে বিদ্যুতে রূপান্তর করতে শক্তি-শোষণকারী কোষ সহ সিলিকন শীট ব্যবহার করে। সৌর শক্তি একটি তুলনামূলকভাবে অ্যাক্সেসযোগ্য সম্পদ, এবং লোকেরা ভবন এবং বাড়িতে সৌর প্যানেল ইনস্টল করে শিল্প বা পৃথকভাবে সৌর শক্তি ব্যবহার করতে পারে। আর তাই সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। সৌর শক্তি নবায়নযোগ্য শক্তি সেক্টরের একটি ক্রমবর্ধমান খাত। সৌর শক্তি উৎপাদন অবকাঠামো প্রতি বছর ২৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলবিদ্যুৎ
জলবিদ্যুৎ একটি উন্নত প্রযুক্তি। পড়ন্ত বা স্রোত আছে এমন নদীর পানির চাপকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয় জলবিদ্যুৎ। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নদীতে প্রবাহিত স্রোত থেকে গতিশক্তি ধারণ করে এবং একটি বাঁধে নির্মিত টারবাইন ব্যবহারের মাধ্যমে গতিশক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি করা হয়। জলবিদ্যুৎ পৃথিবীর মোট বিদ্যুতের ২০% এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ৮৮% উৎপন্ন করে থাকে।
বায়ু শক্তি
বায়ু শক্তি হলো সবুজ শক্তির মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত শক্তি। এই প্রক্রিয়ায় টারবাইনের সাহায্যে গতিশক্তিকে রূপান্তর করে যান্ত্রিক বা বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত বায়ু শক্তি বিশ্বের মোট বিদ্যুতের ৭ শতাংশেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে অবদান রেখেছিলো। বায়ু শক্তির ব্যবহারে খুব বেশি মানুষের শ্রমের প্রয়োজন হয় না এবং এটি সবচেয়ে পরিবেশ বান্ধব শক্তির উৎস হিসেবে পরিচিত।
ভূ-তাপীয় শক্তি
ভূ-তাপীয় শক্তি হল নবায়নযোগ্য শক্তি যা ভূগর্ভস্থ গরম জল বা বাষ্প ব্যবহার করে পৃথিবীর পৃষ্ঠের নীচে প্রাকৃতিক তাপ দ্বারা সৃষ্ট। নিম্ন তাপমাত্রা জিওথার্মাল উৎসগুলো ইনস্টল করে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলোকে তাপ এবং শীতল করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। পৃথিবীর ভূত্বকের নীচে থাকা তরল এবং শিলাগুলোর মধ্যে থাকা তাপ শক্তি তৈরি করতে পারে। বাষ্প এবং গরম জল থেকে ভূ-তাপীয় শক্তি ব্যবহার করার জন্য, শ্রমিকরা ভূগর্ভস্থ জলাধারে মাইল-গভীর কূপ খনন করে। তারপর তারা এই বাষ্প এবং গরম জল বিদ্যুৎ জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত টারবাইনে ব্যবহার করে।
ফুয়েল সেল
বিশ্বজুড়ে বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে যেসব প্রযুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তার মধ্যে ফুয়েল সেল বা জ্বালানি কোষ অন্যতম। ফুয়েল সেল হচ্ছে এমন একটি তড়িৎ রাসায়নিক কোষ যেখানে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় সরাসরি ডিসি কারেন্ট হয় এবং বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পানি এবং তাপ উৎপন্ন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে ফুয়েল সেল বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।
ফুয়েল সেলের মধ্যে মিথানল ফুয়েল সেল, ইথানল ফুয়েল সেল, গলিত কার্বনেট ফুয়েল সেল , পোটন এক্সচেঞ্জ মেমব্রেন ফুয়েল সেল বেশ জনপ্রিয়। ফুয়েল সেল বৈদ্যুতিক যানবাহন, পাওয়ার প্লান্ট , মহাকাশযান, স্মার্টফোনের পাশাপাশি বিভিন্ন পোর্টেবল চার্জিং অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফুয়েল সেল পরিবেশ বান্ধব, নিরাপদ এবং এর কর্মদক্ষতা অনেক বেশি।
সবুজ শক্তি ব্যবহারের সুবিধা
সবুজ শক্তি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি পরিবেশবান্ধব। বায়ু এবং সৌর শক্তির মতো সবুজ শক্তির উৎস ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ এড়ানোর জন্য উচ্চতর বিকল্প। শুধু তাই নয়, সবুজ শক্তি আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো কারণ এটি আমাদের বায়ু এবং জল দূষণের জন্য অনেক কম দায়ী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গৃহস্থালী এবং পরিবেষ্টিত বায়ু দূষণ বছরে বিশ্বজুড়ে ৪.২ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ । এই মৃত্যুগুলোর বেশিরভাগই নিম্ন- থেকে মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঘটেছে। এই কারণে, আমাদের অবশ্যই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোতে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
বায়ু শক্তি এবং সৌর শক্তির মতো সবুজ শক্তির উৎস জীবাশ্ম জ্বালানীর তুলনায় অনেক বেশি টেকসই বিকল্প। তারা অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড এবং সালফার ডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ করে না, যার ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। নবায়নযোগ্য শক্তি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ করে দিচ্ছে। ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০০,০০০ লোককে কর্মসংস্থান করে দিয়েছে এই সবুজ শক্তি। সবুজ শক্তির আরেকটি সুবিধা হলো নবায়নযোগ্য শক্তি কখনো নিঃশেষ হবে না। সূর্য যতদিন চলতে থাকবে ততদিন সৌর শক্তি পাওয়া যাবে, বাতাস যতক্ষণ বয়ে চলবে ততক্ষণ বায়ু শক্তি পাওয়া যাবে এবং হ্রদ, প্রবাহ এবং নদী যতক্ষণ প্রবাহিত থাকবে ততক্ষণ জলবিদ্যুৎ বিদ্যুৎ থাকবে।
পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সবুজ শক্তির কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীকে দূষণের হাত থেকে, গ্রিন হাউস গ্যাসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে আমাদেরকে ধীরে ধীরে সবুজ শক্তির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে নবায়নযোগ্য খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। আমরা যদি এখন থেকেই সবুজ শক্তির উপর নির্ভরশীল না হই, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
Comments