Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার |
বিখ্যাত কবি মার্ক টোয়েন বলেছেন- “ভাল বন্ধু, ভাল বই এবং একটি শান্ত বিবেক: এটি আদর্শ জীবন”। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা ধীরে ধীরে বই পড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। কৈশোরে পাঠ্যবইয়ের ভেতরে গল্পের বই লুকিয়ে পড়তে গিয়ে মায়ের কাছে বকুনি খাওয়া কিংবা বিকেল বেলা না ঘুমিয়ে তিন কিশোর গোয়েন্দা, হুমায়ুন আহমেদ পড়ার মতো দিনগুলো এখন শুধুই অতীত।
মোবাইল কিংবা আধুনিক গ্যাজেটের ছোঁয়া পাওয়া কিশোর-কিশোরীরা পথের পাঁচালি পড়ে আবেগে আপ্লুত হওয়ার আনন্দ বোঝে না, নতুন বইয়ের ঘ্রাণে তারা আর মাতোয়ারা হয় না। কিন্তু ব্যক্তির মানসিক বিকাশের জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। বই পড়ার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ওমর খৈয়ামের কবিতার ভাবানুবাদ করে বলেছিলেন, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়।” কিভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন এ বিষয়ে আজকে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
লক্ষ্য নির্ধারণ
বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্যটি হতে হবে স্পষ্ট। বই পড়ার নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে তা শুধু বিনোদন নয় বরং জীবনের নানা ক্ষেত্রে জানার পরিধি বাড়াতে সহায়তা করে। যেমন আপনার যদি লক্ষ্য থাকে আপনি রাজনীতি সম্পর্কে জানবেন , সেক্ষেত্রে রাজনীতি বিষয়ক বই আপনার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির পাশাপাশি আপনাকে মানসিক প্রশান্তিও দিবে। আর তাই আপনাকে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে যে আপনি কোন ধরনের বই পড়বেন অর্থনীতি, আধ্যাত্মিক জগত, শিক্ষা সংস্কৃতি, কর্মজীবন, নাকি অন্য কিছু। যখন কারো পড়ার লক্ষ্য আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে , তখনই পড়ার প্রতি তার আগ্রহ জন্মাবে এবং অনুপ্রেরণা বাড়বে বই পড়াকে অভ্যাস হিসেবে গড়ে তুলতে।
আপনি চাইলে বছরে কয়টি বই পড়বেন সে লক্ষ্য ঠিক করতে পারেন। মাসে ২টি করে বছরে ২৪টি বই পড়ার লক্ষ্য স্থির করতে পারেন। এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রতি মাসে যদি অন্তত একটি বই পড়া যায় তাহলে বছরে ১২টি বইয়ের বড় লক্ষ্য কিন্তু খুব সহজেই অর্জন করা যায়। তবে এটিকে বাধ্যতামূলক ভাবা যাবে না। তাহলে বিষয়টি বিরক্তিকর হতে পারে। আপনাকে পুরো প্রক্রিয়াকে উপভোগ করতে হবে।
বইয়ের তালিকা তৈরি
বই পড়া নিয়ে পুরো বছরের লক্ষ্য নির্ধারণ হয়ে গেলে আপনাকে বইয়ের একটি তালিকা করতে হবে। তালিকায় আপনি যে বই পড়তে চান তার নাম লিখুন। এক্ষেত্রে আপনি বন্ধু কিংবা অন্যদের পরামর্শ নিতে পারেন। তালিকা তৈরির জন্য আপনি জার্নাল, নোটপ্যাড বা এক্সেল স্প্রেডশিট ব্যবহার করতে পারেন। সেখানে প্রতি মাসে বা এক বছরের মধ্যে যেসকল বই পড়তে চান তার তালিকা তৈরি করুন। তবে তালিকায় অবশ্যই নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। আপনি যদি উপন্যাসের বই পড়তে পছন্দ করেন, তবে তালিকায় উপন্যাসকে প্রাধান্য দিন।
প্রতিদিন অন্তত ১০-২০ পৃষ্ঠা পড়ুন
বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পৃষ্ঠা পড়ার লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০-২০ পৃষ্ঠা পড়তে পারেন। বিশেষ করে যদি আপনার ব্যস্ত সময়সূচী থাকে, তবে এই প্রক্রিয়া আপনার জন্য বেশ কার্যকর হবে। আপনি যখন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক পৃষ্ঠা পড়ার লক্ষ্য অর্জনের সচেষ্ট থাকবেন, তখন ধীরে ধীরে আপনার বই পড়ার অভ্যাস হয়ে যাবে। একসময় দেখা যাবে আপনার পড়ার পরিমাণ নির্দিষ্ট পৃষ্ঠাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। শুধু তাই নয়, বই পড়া আপনার নিত্যদিনের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে।
পড়ার মাধ্যম ও পরিবেশ তৈরি
পড়ার জন্য মাধ্যম নির্ধারণ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- অনেকে হার্ড কপি পড়তে পছন্দ করেন। তাদের জন্য পড়ায় মনোনিবেশ বাড়াতে আরামদায়ক টেবিল এবং চেয়ায়ের সঙ্গে কোলাহলমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। বইয়ের সাথে কিন্তু সবুজ প্রকৃতির এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আপনি বারান্দা কিংবা বাসার একটি নির্দিষ্ট কর্ণারে কিছু গাছ লাগিয়ে বই পড়ার জন্য জায়গাটিকে তৈরি করতে পারেন। বর্তমানে অনেকেই মোবাইল অ্যাপস, ট্যাবলেট, নিউজ এগ্রিগেটর, ইবুক রিডার এবং অন্যান্য অনলাইন গেজেটে বই পড়তে অভ্যস্ত। আপনি হার্ড কপি নাকি সফট কপি পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন তা নির্ধারণ করতে হবে। অবশ্যই পড়ার পরিবেশ বজায় রাখার দিকে নজর দিতে হবে।
বইময় দিন
আপনি চাইলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন কিংবা মাসের একটি নির্ধারিত দিনকে বইময় দিন হিসেবে রাখতে পারেন। সেদিন আপনি অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি সময় বই পড়ার জন্য বরাদ্দ রাখুন। আপনি চাইলে লাইব্রেরি যেতে পারেন কিংবা ভিভা, বেঙ্গল বইয়ের মতো বই ক্যাফেতে যেতে পারেন। আপনি চাইলে নীলক্ষেত গিয়ে বই কিনতে পারেন। আপনি যখন নীলক্ষেতের মতো বইয়ের রাজ্যে যাবেন, তখন আপনার এমনিই বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে।
বই মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু। নিজের মানসিক বিকাশের জন্য, ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই আমাদেরকে এই যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি দিয়ে মানসিকভাবে ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
Comments