Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার |
‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’– ছোটোবেলা থেকে এই প্রবাদটি শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। কিন্তু আধুনিক এই যুগে আমরা অনেকেই নিজেদের কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, নিজেদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবার-প্রিয়জনকে সময় দেয়া এইসব কিছু থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এক কথায় বলতে গেলে, আমরা আমাদের কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছি না। আজকে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি।
ডিজিটাল যুগে কর্মজীবনের ভারসাম্য বলতে কী বোঝায়?
কর্মজীবনের ভারসাম্য বলতে কাজের জন্য ব্যয় করা সময় এবং শক্তির মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করাকে বোঝায়। এই ভারসাম্য অর্জন শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য, কাজের সন্তুষ্টি বাড়ানো এবং সামগ্রিক সুস্থতার উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল এই যুগে, কর্মজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এআই -এর প্রবর্তন এই জটিলতাকে আরো বেশি জটিল করে ফেলেছে। যার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রভাবই রয়েছে।
কর্মজীবনে এআইয়ের ব্যবহার
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কেবল প্রযুক্তি জগতকেই নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনকেও ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে। অন্য সব খাতের মতো কর্মক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সময় ব্যবস্থাপনা: এআই টুল কর্মীদের কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করে এবং ওয়ার্কফ্লো অপ্টিমাইজ করে তাদেরকে আরো কার্যকরভাবে কাজ করতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, টাস্ক ম্যানেজমেন্টের জন্য এআই-চালিত টুল ‘আসানা’ এবং ওয়ার্কফ্লো অপ্টিমাইজেশানের জন্য ‘নোশন’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এআই-চালিত সময়সূচী সহকারীরা এমন সময়ে মিটিং এর ব্যবস্থা করতে পারে যাতে কর্মীরা নিজেদের জন্য সময় পায় এবং মিটিং কার্যকরী হয়। এছাড়াও, এআই অনেক কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলায় কর্মীরা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন।
কাজের চাপ হ্রাস: এআই-চালিত সফ্টওয়্যার রুটিন কাজ যেমন ডাটা এন্ট্রি, শিডিউলিং, ইমেইল ফিল্টারিং ইত্যাদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারে। এতে কর্মীরা সহজেই নিজেদের কাজ করতে পারছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান সময়ে স্মার্ট হোমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। যেমন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘গুগল নেস্ট’ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ‘রিং’ ব্যবহার করা হয়। এই স্মার্ট হোমে ব্যবহৃত এআই প্রযুক্তি গৃহের পরিবেশকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে, গৃহ ব্যবস্থাপনায় মানুষের মানসিক দুশ্চিন্তা এবং সময়ের ব্যয় কমায়। এতে মানুষ সীমিত সময়কে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারছে।
কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি: কর্মজীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব গভীর এবং প্রতিশ্রুতিশীল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মক্ষেত্রের ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। ডেটা সায়েন্স টুলস যেমন ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের জন্য ‘টেবলো’ এবং ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণের জন্য ‘আইবিএম ওয়াটসন’ সফটওয়্যার ডেটাকে সহজে বিশ্লেষণ করে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করছে। প্রেজেন্টেশন, কন্টেন্ট রাইটিং,রিসার্চ, প্রজেক্ট তৈরি সকল ক্ষেত্রেই এআইকে ব্যবহার করা হচ্ছে কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি করার জন্য। পুরোপুরি এআই-এর উপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং এআইকে ব্যবহার করে কর্মক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং মানসিক সুস্থতায় এআই : এআই ব্যক্তিগত বিকাশেও অবদান রাখছে। মেশিন লার্নিং মডেল জনপ্রিয় ‘কোর্সেরা’ এবং ‘খান একাডেমি’ মতো প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরো শক্তিশালী এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলছে। একইভাবে, এআই-চালিত সুস্থতা অ্যাপ্লিকেশন যেমন ‘ফিটবিট’ এবং ‘হেডস্পেস’ ব্যক্তিগত শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখে। এছাড়াও, কিছু এআই টুল মানসিক কাউন্সেলিং অফার করে থাকে। যদিও এটি সয়ংক্রিয় যন্ত্র কিন্তু তবুও ব্যস্ত এই পৃথিবীতে এআই-এর সাথে কথা বলেও অনেকে ভালো অনুভব করেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং দ্বিধা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে বিশ্ববাসী পরিচিত হওয়ার পর থেকেই অনেক মানুষের মনে দ্বিধা এবং আতঙ্ক লক্ষ্য করা গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কর্মসংস্থান দখল করার আশংকা নিয়ে। ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম অনুমান করেছিল যে ২০২৫ সালের মধ্যে অটোমেশন মোটামুটি ৮৫ মিলিয়ন চাকরি স্থানচ্যুত করবে। একই সাথে, ৯৭ মিলিয়ন নতুন কর্মচারী যারা অ্যালগরিদম, মেশিন লার্নিং নিয়ে জানে এবং দক্ষ তারা সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিছু কিছু চাকরি দখল করে নিলেও নতুন অনেক কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তবে মানুষ এই প্রযুক্তির উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার কারণে, মানুষের সৃজনশীলতা হুমকির মুখে পড়ছে। এআই ব্যবহারের ফলে কর্মীদের গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এছাড়াও, এআই ব্যবহার করে অপরাধ করার সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এআই এবং কর্মজীবনে ভারসাম্য রক্ষার কৌশল
এআই ব্যবহার করে কিছু কৌশল অনুসরণ করার মাধ্যমে আমরা সহজেই কর্মজীবনে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবো। নিচে কয়েকটি কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো-
প্রথমত, কর্মজীবনে বাউন্ডারি নির্ধারণ করতে হবে। কর্মচারীদের তাদের কর্ম-জীবনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি বাউন্ডারি স্থাপন করা উচিত। কখন কাজ করবে, কখন ব্যক্তিগত জীবনে সময় ব্যয় করবে এই সবকিছু নির্দিষ্ট করতে হবে। কখনোই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করা উচিত নয়। শুধু তাই নয়, কোন কাজে এআই ব্যবহার করবে, কতটুকু কাজ এআই-এর সাহায্যে করবে এই সবকিছুর একটি বাউন্ডারি থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। কর্ম-জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপের মাত্রা নিরীক্ষণ, মননশীলতা অনুশীলন এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার জন্য এআই-চালিত সুস্থতা সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। শারীরিক এবং মানসিকভাবে আপনি যতো সুস্থ থাকতে পারবেন, ততো সহজেই কর্ম-জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবেন।
তৃতীয়ত, কার্যকরভাবে এআই ব্যবহার করতে হবে। যেসব কাজ এআই ব্যবহার করে সহজে করা যায়, তা করতে হবে। তবে পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। যেমন- লেখালেখি, রিসার্চ এসব কাজে এআই থেকে সাহায্য নিয়ে সুন্দরভাবে করা যায়। নিজের সৃজনশীলতা এবং এআই উভয়ের সাহায্যে কর্ম-জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।
এআই কর্ম-জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিগত এবং কর্মজীবনের অনেক কাজ সয়ংক্রিয় করে এআই আমাদের সাহায্য করছে। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা এআই নিয়ে সমলোচনা রয়েছে তবুও সঠিকভাবে এআই ব্যবহার করতে পারলে, ডিজিটাল এই যুগে সকলের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব।
Comments