Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার |
‘ডেডলাইন’ কিংবা ‘সময়সীমা’ এই শব্দটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। শিক্ষাজীবনে অ্যাসাইনমেন্ট, টার্মপেপার কিংবা প্রেজেন্টেশন , চাকুরি জীবনে যেকোনো কাজেই একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি কেনো আমরা ডেডলাইনের পূর্বে কোনো কাজ শেষ করতে পারি না? কিংবা ডেডলাইন শেষ হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে কেনো আমরা কাজ শেষ করা নিয়ে তাড়াহুড়ো করি? এই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ সিরিল নর্থকোট পারকিনসন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে। সকলের কাছে তা পার্কিনসন’স ল নামে পরিচিত। আজকে আমরা এই পার্কিনসন’স ল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
পার্কিনসন’স ল কি ?
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ সিরিল নর্থকোট পারকিনসন-এর একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে যার মাধ্যমে সহজেই পার্কিনসন’স ল বোঝা যায়। তিনি বলেছেন,
“কোনো কাজ তার জন্য বরাদ্দ সময়ের সবটুকু ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তার ব্যাপ্তিকে বাড়িয়েই চলে।”
অর্থাৎ, যখন কোনো কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য আরও সময় দেওয়া হয় তখন কাজটি সম্পূর্ণ করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ কাজটি তখন চাপযুক্ত এবং ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এর মানে হলো, বেশিরভাগ মানুষই তাদের দেওয়া সময়সীমাটি সম্পূর্ণ পরিমাণে ব্যবহার করবে, এমনকি যদিও হাতে থাকা কাজটি অনেক কম সময়ে করা যায়।
পারকিনসন’স ল কে দক্ষ সময় ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। পারকিনসন কিন্তু এই অসুবিধাটি আবিষ্কার করেননি। তবে তিনি মানুষের এই বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন এবং খুব ভালোভাবে বর্ণনা করেছেন।
পেছনের ইতিহাস
“এটি একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ যে কাজটি প্রসারিত হয় যাতে এটির সমাপ্তির জন্য উপলব্ধ সময় পূরণ করা যায়।” ব্রিটিশ নৌ ইতিহাসবিদ এবং লেখক সিরিল নর্থকোট পারকিনসন ১৯৫৫ সালে দ্যা ইকোনমিস্ট-এ একটি প্রবন্ধের জন্য উদ্বোধনী লাইনে লিখেছিলেন, কিন্তু ‘পারকিনসন’স ল’ নামে পরিচিত ধারণাটি আজও বেঁচে আছে।
পারকিনসনের মূল প্রবন্ধটি ছিল ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের উপর ভিত্তি করে। ১৯১৪ থেকে ১৯২৮ সালের মাঝে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে মোট জাহাজ সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়, কর্মকর্তাদের সংখ্যা কমে যায় এক-তৃতীয়াংশ, অথচ নিযুক্ত আমলাদের সংখ্যা এক বছরেই বেড়ে যায় ৬%। কর্মকর্তা ও জাহাজ সংখ্যা উভয়েই কমে যাওয়ার পরও শুধু ব্যবস্থাপনার দোহাই দিয়ে আমলাদের উপস্থিতির হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কম কাজের কারণে স্বাভাবিকভাবেই কম জনবলই যথেষ্ট কিন্তু ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ দেখে মনে হচ্ছিল, এ যেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
ভিয়েনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপ্লেক্স সিস্টেমের বিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টেফান থার্নার পারকিনসন’স ল নিয়ে আরো বিস্তারিত কাজ করেন। তার মূল কাজের অনুপ্রেরণা ছিল স্বীয় কর্মস্থল মেডিসিন বিভাগ যখন ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনা থেকে পৃথক হয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশের সিদ্ধান্ত। ২০০৪ সালে মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনার যাত্রা শুরু হওয়ার ৪বছরের মাথায় এর কর্মীসংখ্যা মাত্র ১৫ থেকে ১০০ তে উন্নীত হয়, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বিজ্ঞানীর সংখ্যা অপরিবর্তিত ছিল।
থার্নার এরপর পারকিনসনের পুরো বইটা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হয়ে তার উপর ভিত্তি করে একটি গাণিতিক রূপরেখা তৈরি করলেন। তিনি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, ওশেনিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহের মন্ত্রিপরিষদের আকার পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মন্ত্রিপরিষদের আকার মূলত একটি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য, জনগণের উন্নয়নের সূচক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহি, সরকারের কার্যকারিতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, মন্ত্রিপরিষদের আকার যত বড় হবে, সরকারের উৎপাদনশীলতা তত হ্রাস পাবে।
কিভাবে পারকিনসন’স ল থেকে নিজেকে এড়ানো যায়
পারকিনসন’স ল কোনো জাদু সূত্র বা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম নয়। কিন্তু এটি একটি পর্যবেক্ষণ যা আপনি আপনাকে আরও উৎপাদনশীল হতে সাহায্য করতে ব্যবহার করতে পারেন। আমরা কিছু কৌশল নিয়ে আলোচনা করবো যাতে আপনি পারকিনসন’স ল থেকে নিজেকে এড়াতে পারেন।
সময় অনুসারে পরিকল্পনা করা
যখন আপনার কাছে একটি কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য অনেক সময় থাকে, তখন আমরা কাজকে পরে করবো ভেবে ফেলে রাখি। তবে আপনি যদি আপনার সময় অনুসারে পরিকল্পনা করেন এবং নিজের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করেন তবে বিলম্বের ফাঁদে পড়া থেকে নিজেকে এড়াতে পারেন।
আপনার লক্ষ্য লিখুন
আপনার লক্ষ্য ছোটো-বড় যাই হোক না কেন, তা লিখে রাখুন। নিয়মিত চেক ইন করে আপনার অগ্রগতি ট্র্যাক করুন এবং কী করা দরকার, এবং প্রকল্প চলাকালীন আপনার চূড়ান্ত লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়েছে কিনা তার দিকে নজর রাখুন। এই ধরনের প্রতিফলিত লক্ষ্য-ট্র্যাকিং আপনাকে শুধু জবাবদিহি করতে সাহায্য করে না, বরং এটি আপনাকে আপনার অগ্রগতি, আপনার অবশিষ্ট কাজ সম্পর্কে ধারণা দেয়।
কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন
আপনার যদি অনেকগুলো কাজ শেষ করার থাকে তবে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ৷ কোন কাজগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা শনাক্ত করার মাধ্যমে, আপনি নিশ্চিত করতে পারেন যে আপনি প্রথমে সেগুলোতে ফোকাস করছেন এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পরবর্তী সময়ের জন্য রাখছেন।
টাইমার ব্যবহার করুন
পারকিনসন’স ল এড়াতে একটি কার্যকর উপায় হল একটি টাইমার ব্যবহার করা। আপনি যখন জানেন যে আপনার কাছে একটি কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় আছে, তখন উপলব্ধ সময় পূরণ করতে আপনার কাজটি প্রসারিত করার সম্ভাবনা কম।
কাজগুলোকে ব্রেক ডাউন করুন
বৃহত্তর প্রকল্পগুলোকে ছোট ছোট কাজে বিভক্ত করুন এবং পুরো প্রকল্প জুড়ে নিজেকে স্ব-আরোপিত সময়সীমা দিন। একটি বড় প্রকল্পের মুখোমুখি হওয়ার সময়, এটি প্রায়শই এটির চেয়ে বেশি কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কাজগুলোকে ভাগ করার পরে আপনার জন্য কাজ করা বেশ সহজ মনে হবে।
পারকিনসন’স ল আমাদেরকে নষ্ট সময় এবং অদক্ষ কাজের সম্পর্কে ধারণা দেয়। কেনো আমরা কোনো কাজ শেষ মুহুর্তের জন্যে ফেলে রাখি সেসম্পর্কে ধারণা দেয়। তাই আপনি যদি এটি সম্পর্কে সচেতন হন তবে সম্ভাব্য সমস্যা হতে রেহাই পেতে পারেন। উপরের কিছু কৌশল ব্যবহার করে, আপনি পারকিনসন’স ল -এর শিকার হওয়া এড়াতে পারেন এবং আপনার সময়ের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারেন।
Comments