ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড বিসনেস ইমপ্যাক্ট

স্লো ফ্যাশন: পরিবেশ সচেতন ও নৈতিক ফ্যাশনের নতুন ধারা

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়শা মারিয়া

ফ্যাশন জগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পরিবেশ-বান্ধব ধারণা হলো স্লো ফ্যাশন। এটি এমন একটি ধারণা যা ফ্যাশনের দ্রুত পরিবর্তনশীল ও ট্রেন্ড-নির্ভর ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও মানসম্মত পোশাক তৈরির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। বর্তমান বিশ্বে যখন ফাস্ট ফ্যাশনের কারণে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তখন স্লো ফ্যাশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

স্লো ফ্যাশনের মূলনীতি

স্লো ফ্যাশন মূলত পোশাক উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও ব্যবহৃত কাচামালের প্রতি গুরুত্ব দেয়। এটি নতুন পোশাকের উৎপাদন কমিয়ে, পুরোনো পোশাক পুনর্ব্যবহার ও আপসাইকেলিংয়ের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করে। স্লো ফ্যাশনের মূলনীতি হলো নতুন পোশাক উৎপাদন কমানো বা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা। এটি একটি প্রক্রিয়া, যেখানে উৎপাদনশীলতা কম রাখা হয় এবং নতুন পণ্য তৈরির পরিবর্তে পুরোনো বা বিদ্যমান পোশাককে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা হয়। এভাবে পানির অপচয় ও পরিবেশ দূষণ কমানো যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সাধারণ টি-শার্ট তৈরিতে প্রায় ২,৭০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এই ধরনের অপচয় রোধ করাই স্লো ফ্যাশনের অন্যতম লক্ষ্য।

স্লো ফ্যাশনের মূলনীতি চিত্রায়িত হয়েছে—পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, নৈতিক শ্রমনীতি, ও টেকসই উপকরণের ব্যবহার।

বাংলাদেশের স্লো ফ্যাশন উদ্যোগ

বাংলাদেশে স্লো ফ্যাশনের ধারণা তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও ইতোমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ এই ধারায় কাজ শুরু করেছে। উল্লেখযোগ্য একটি উদ্যোগ হলো ‘ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরস’। এই ব্র্যান্ডটি দেশের প্রথম স্লো ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের ডিজাইন টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন ডিজাইনার ইমাম হাসান। ফ্রেন্ডশিপ এনজিওর এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের চিরাচরিত পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রাকৃতিক ও এজোমুক্ত রঙ ব্যবহার করে পোশাক তৈরি করে। তাদের কার্যক্রমে চর অঞ্চলের প্রান্তিক নারীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে দক্ষ কর্মী হিসেবে যুক্ত হচ্ছেন, যা তাদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করছে।

বাংলাদেশে সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়ে কাজ করা উদ্যোগগুলোর মধ্যে ‘ব্রোক’ অন্যতম। তারা পুরোনো ব্যবহৃত কাপড়কে আপসাইকেলিং ও ক্র্যাফটিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। এভাবে তারা পরিবেশ দূষণ কমানো ও পানির অপচয় রোধে অবদান রাখছে। তাদের পণ্য তালিকায় মাস্ক, হুডি, জগার, ক্যাজুয়াল প্যান্ট, ডেনিম এবং টি-শার্টের আপসাইকেলড ভার্সন রয়েছে, যা সাসটেইনেবল ফ্যাশনের ধারণাকে পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত করে।

স্লো ফ্যাশন বনাম ফাস্ট ফ্যাশন

ফাস্ট ফ্যাশন একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল ফ্যাশন শিল্প যেখানে পোশাক কম খরচে উৎপাদন ও দ্রুত বাজারজাত করা হয়। এটি সাধারণত নিম্নমানের এবং স্বল্পস্থায়ী পোশাক তৈরির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যা কয়েকবার পরার পরেই ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি হয় এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

অন্যদিকে, স্লো ফ্যাশন মানসম্মত ও দীর্ঘস্থায়ী পোশাক তৈরি করে, যা দীর্ঘ সময় ব্যবহার উপযোগী হয়। এটি শুধুমাত্র একটি ফ্যাশন প্রবণতা নয়; বরং এটি একটি জীবনধারা, যা আমাদের ক্রয় ও ব্যবহার অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে উদ্বুদ্ধ করে।

স্লো ফ্যাশন বনাম ফাস্ট ফ্যাশন তুলনামূলক চিত্র—টেকসইতা, নৈতিকতা ও মানের দিক থেকে স্লো ফ্যাশনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

সাসটেইনেবল ফ্যাশনের সঙ্গে সম্পর্ক

স্লো ফ্যাশন এবং সাসটেইনেবল ফ্যাশন পরস্পর সম্পর্কিত। স্লো ফ্যাশন, ফ্যাশন শিল্পকে ধীর করার উপর জোর দেয়, যেখানে সাসটেইনেবল ফ্যাশন পরিবেশ-বান্ধব উপকরণ ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করে টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করে। উভয় ধারণাই ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং নৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব দেয়।

স্লো ফ্যাশনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

স্লো ফ্যাশন শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; এটি একটি সামাজিক আন্দোলনও। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কাজের সুযোগ করে দেওয়া এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। স্থানীয় ক্রাফট ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের চর অঞ্চলের নারীদের জন্য ‘ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরস’ যেমন একটি আশীর্বাদ স্বরূপ। তারা এখান থেকে উপার্জনের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। একই সঙ্গে স্থানীয় বয়নশিল্প পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।

স্লো ফ্যাশনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে—স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্থানীয় শিল্পের উন্নয়ন ও সচেতন ভোক্তা সংস্কৃতির প্রসার।

কেন স্লো ফ্যাশন গ্রহণ করবেন?

স্লো ফ্যাশন গ্রহণের মাধ্যমে আমরা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে পারি। এটি আমাদের কেনাকাটা কম করতে, ভালো মানের পণ্য নির্বাচন করতে এবং পোশাকের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করে। ফলে পোশাক শিল্পের কারণে সৃষ্ট বর্জ্য ও দূষণ হ্রাস পায়।

স্লো ফ্যাশন একটি নৈতিক ও পরিবেশ-বান্ধব ফ্যাশন প্রবণতা, যা আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি শুধুমাত্র একটি ফ্যাশন প্রবণতা নয়; বরং একটি জীবনধারা, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ ও টেকসই পৃথিবী গড়তে সহায়ক।

“তথ্যসূত্র”

গুগল স্কলার: একাডেমিক গবেষণার প্রবেশদ্বার

Previous article

কীভাবে এক অনন্য ব্যবসার মডেল দাঁড় করালো টেসলা

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *