ব্র্যান্ডিং স্ট্রাটেজিস

স্টারবাকসের ‘প্রিমিয়াম অভিজ্ঞতা’ কৌশল : গ্রাহক ধরে রাখার মাস্টারপ্ল্যান

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার

বিশ্বব্যাপী পানীয় হিসেবে কফির আলাদা কদর রয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কিংবা অফিসে কাজের প্রেশারের মাঝে অথবা ব্যস্তময় কর্মদিবসের শেষে ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই কফির উপর নির্ভরশীল। কারো কাছে কফি আবার মন ভালো করার ওষুধ। উন্নত জাতের কফি বিন থেকে তৈরি কফির রয়েছে আলাদা স্বাদ ও চাহিদা। সেই সাথে রয়েছে উচ্চমূল্য। কিন্তু কফিপ্রেমীরা চড়া দামেই সেসব কফির স্বাদ গ্রহণ করেন। আমাদের দেশে চায়ের কদর বেশি হলেও ইউরোপ, আমেরিকায় মানুষের কাছে কফির চাহিদা অনেক বেশি।

কফির এই চাহিদার কারণে এসব দেশে বহুকাল আগে থেকেই কফি বিন বিক্রির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া, বিভিন্ন উদ্যোক্তা একক বা যৌথভাবে কফি হাউজ বা কফি রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালু করেছে। কেউ কেউ সফলভাবে ব্যবসা এগিয়ে নিতে পেরেছে, কেউ আবার ব্যর্থ হয়েছে। আজকে আমরা জানবো কীভাবে একটি কফি হাউজ শূন্য থেকে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সফল কফিশপের রূপ নিয়েছে। যখনই আমরা কফিশপের কথা ভাবি, আমাদের মনে পড়ে স্টারবাকসের কথা। ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে ২০২২ সালে স্টারবাকস ২৬.৫১ বিলিয়ন ডলার মোট আয় করেছে। চলুন জেনে নেই কিভাবে কিছু বিজনেস কৌশল অনুসরণ করে স্টারবাকস বিশ্বব্যাপী এতো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। 

শুরুর গল্প 

স্টারবাকসের পথচলা শুরু হয় সত্তরের দশকে তিন ব্যক্তির হাত ধরে। তিন বন্ধু জেরি বোল্ডউইন, গর্ডন বোকার এবং জেভ সিগল মিলে আমেরিকার ওয়াশিংটনের সিয়াটল শহরে কিছু করার পরিকল্পনা করছিলেন। ১৯৬২ সালে গর্ডন ইতালির মিলানে বেড়াতে গিয়ে সেখানে যে কফি পান করেন, সেটার স্বাদ তার কাছে অতুলনীয় মনে হয়। সেরকম মানসম্মত কফির খোঁজে তিনি প্রায়ই সিয়াটল থেকে ভ্যাঙ্কুভার শহরে যেতেন কফি বিন আনার জন্য। তিনি তার বাকি দুই বন্ধুকেও এই কফির ব্যাপারে বলেন। সেখান থেকেই তাদের মাথায় কফিশপ চালু করার চিন্তা আসে।

স্টারবাকসের যাত্রার শুরু, সত্তরের দশকে তিন প্রতিষ্ঠাতার প্রচেষ্টার প্রতীক।

স্টারবাকসের পথচলা শুরু হয় সত্তরের দশকে তিন ব্যক্তির হাত ধরে। | ছবি সংগৃহীত।

সেসময় বেশিরভাগ আমেরিকানই সস্তা ও কম-গ্রেডের কফি পান করত। যেহেতু কফিশপ ব্যবসা সম্পর্কে তাদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই জেভ সিগল পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে বিভিন্ন খবরের কাগজ আর ফোনবুক ঘেঁটে আলফ্রেড পিট নামের এক ব্যক্তির খোঁজ পান। তিনি ছিলেন পিটস কফির মালিক, যিনি আমেরিকায় প্রথম রোস্টেড কফি এনেছিলেন। তার কাছ থেকে কফির ব্যবসা পদ্ধতি শেখার পর তারা তিনজন মিলে সিয়াটলের পাইক প্লেস মার্কেটে ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ একটা কফিশপ চালু করেন। মূলধন হিসেবে তিন বন্ধুর প্রত্যেকে ১,৩৫০ ডলার বিনিয়োগ করেন, এবং সেই সাথে আরও ৫,০০০ ডলার ঋণ নিয়ে স্টারবাক্‌সের প্রথম কফিশপ চালু করেন। 

তবে আমরা বর্তমান যে স্টারবাকস দেখতে পাই, তার সফলতা আসে মূলত হাওয়ার্ড শুল্টজের হাত ধরে। ১৯৮৭ সালে তিনি কিছু বিনিয়োগকারীর সহায়তায় ৩.৮ মিলিয়ন ডলারে স্টারবাকস কিনে নেন। তারপর থেকেই বদলে যায় স্টারবাকসের চিত্র।

স্টারবাকসের সাফল্যের পেছনে হাওয়ার্ড শুল্টজের নেতৃত্বের প্রতীক।

স্টারবাকসের সফলতা আসে মূলত হাওয়ার্ড শুল্টজের হাত ধরে। | ছবি সংগৃহীত।

স্টারবাকসের বিজনেস কৌশল 

হাওয়ার্ড শুল্টজ স্টারবাকসকে সফল করার জন্য কিছু বিজনেস কৌশল অনুসরণ করেন। আমরা এখন সেসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। 

প্রিমিয়াম গ্রাহক অভিজ্ঞতা

স্টারবাকস সবসময় উচ্চ-মানের পণ্যের উপর জোর দিয়ে একটি প্রিমিয়াম গ্রাহক অভিজ্ঞতা প্রদান করে। গ্রাহকেরা যাতে একটি উচ্চতর এবং আরামদায়ক পরিবেশে সর্বাধিক ব্যক্তিগতকৃত পরিষেবা উপভোগ করতে পারেন সেদিকে কোম্পানিটি সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়। প্রিমিয়াম অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য স্টারবাকস তার নিজস্ব কফি বিন সোর্সিং এবং রোস্ট করে। নানা স্বাদের কফির পাশাপাশি কোম্পানিটি চা, পেস্ট্রি এবং স্যান্ডউইচ সহ অন্যান্য উচ্চ-মানের পণ্যও অফার করে থাকে  যা গ্রাহকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়।

স্টারবাকসের প্রিমিয়াম গ্রাহক অভিজ্ঞতার অনন্য দৃষ্টান্ত।

স্টারবাকস গ্রাহকদের জন্য প্রিমিয়াম অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করে। | ছবি সংগৃহীত।

স্টারবাকস বারিস্তাস কফির প্রতি তাদের জ্ঞান এবং আবেগের জন্য গ্রাহকদের কাছে বেশ পরিচিত। প্রতিটি গ্রাহকের স্বতন্ত্র স্বাদ এবং পছন্দের উপর ভিত্তি করে তারা অর্ডার নেয় এবং তা প্রদান করে থাকে। শুধু তাই নয়, স্টারবাকস খুব স্মার্টভাবে তার স্টোরের গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা এবং সুবিধা বাড়াতে প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে। তারা মোবাইল অর্ডার, ডিজিটাল পেমেন্ট অপশন, ইন-স্টোর ওয়াই-ফাই, প্রতিটি টেবিলের নিচে চার্জিং প্লাগ এবং আরও অনেক কিছু চালু করেছে। এতে গ্রাহকরা তাদের প্রিমিয়াম অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে পারেন।  

দৃঢ় গ্রাহক সম্পর্ক বজায় রাখা 

শক্তিশালী গ্রাহক সম্পর্ক বজায় রাখা স্টারবাকসের ব্যবসায়িক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোম্পানিটি তার গ্রাহকদের সাথে একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক এবং সংযোগ তৈরি করার লক্ষ্যে স্টারবাকস প্রোগ্রাম, নিয়মিত কেনাকাটার জন্য কুপন কার্ড, জন্মদিনে বিনামূল্যে পানীয় এবং খাবার, গ্রাহকের ক্রয়ের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগতকৃত অফার, বিনামূল্যে রিফিলসহ বিভিন্ন সুবিধা অফার করে। এই প্রোগ্রাম এবং সুবিধাগুলো গ্রাহকদেরকে ফিরে আসতে, নিয়মিত কেনাকাটা করতে এবং ব্র্যান্ডের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে উৎসাহিত করে।

স্টারবাকস মূলত ‘থার্ড প্লেস’ থিওরি মাথায় রেখে তাদের আউটলেটগুলো সাজিয়েছে। কেউ চাইলে একা কফি উপভোগ করতে পারে, কেউ চাইলে নীরব পরিবেশে মিটিং করতে পারে আবার চাইলে বন্ধুদের সাথে কোলাহলময় পরিবেশে কফি উপভোগ করতে পারবেন। আর এই সুযোগ-সুবিধার জন্যই মূলত স্টারবাকসের সাথে গ্রাহকের দৃঢ় সম্পর্ক বজায় থাকে। 

প্রিমিয়াম মূল্য এবং স্থান  

স্টারবাকস একটি প্রিমিয়াম কৌশল প্রয়োগ করে নিজেদের ব্র্যান্ড প্রসারিত করেছে। তারা মূলত গ্রাহকদের বিশ্বাস করিয়েছেন যে, তাদের প্রিমিয়াম মূল্যের কফি কিনলে গ্রাহকেরা প্রিমিয়াম  “স্টারবাকস অভিজ্ঞতা”  অর্জন করতে পারবেন। অনেক গ্রাহক বিশ্বাস করেন যে উচ্চ-মানের পণ্যগুলোর দাম বেশি হয়ে থাকে। গ্রাহকের অভিজ্ঞতা এবং গুণমানের উপর জোর দেওয়ায় গ্রাহকেরা এক কাপ স্টারবাক্স কফির জন্য উচ্চ মূল্য দিতে ইচ্ছুক।

স্টারবাকসের প্রিমিয়াম মূল্য নির্ধারণ এবং অনন্য স্থান নির্বাচনের প্রতীক।

স্টারবাকসের প্রিমিয়াম মূল্য এবং স্থানের অনন্য সমন্বয়। | ছবি সংগৃহীত।

স্টারবাকসের চেইন স্টোরগুলির সাফল্য মূলত এর সর্বজনীনতার কারণে। ব্র্যান্ডের ব্যাপক বৈশ্বিক উপস্থিতির জন্য গ্রাহকরা প্রায় যেকোনো জায়গায় ব্র্যান্ড অ্যাক্সেস করতে পারেন। আপনার একটি কফি ফিক্স প্রয়োজন? স্টারবাকস ঠিক চারপাশে। প্রতিটি দোকানে একটি চমত্কার পরিবেশ আছে। স্টারবাকস “থার্ড প্লেস” পজিশনিং কৌশলের কারণে লোকেরা এটিকে তাদের বাড়ি এবং অফিসের পরে দেখা করার জন্য আরেকটি অপরিহার্য স্থান হিসাবে দেখেছে। তাদের পানীয় এবং স্ন্যাকস পেতে এখন আর স্টোরগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় না। মানুষ অনলাইনেও এখন অর্ডার করতে পারেন।  

কৌশলগত বৈশ্বিক সম্প্রসারণ

স্টারবাকসের ব্যবসায়িক কৌশলের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে একটি হলো বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ। ১৯৭১ সালে মাত্র একটি আউটলেট দিয়ে যাত্রা শুরু করে, কোম্পানিটির ১৯৮৭ সালে ১৭ টি আউটলেট ছিল এবং ২০২৩ সালে ৭৬ টি দেশে তাদের ৩৫৭১১ টি আউটলেট ছিলো। অর্থাৎ, গড়ে এই কফি হাউস চেইনটি ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতিদিন ২-৩ টি নতুন আউটলেট খুলেছে।

তাদের বেশ কিছু রোস্টারিও (যেখানে কফি বিন রোস্ট করা হয়) রয়েছে। সবচেয়ে বড় রোস্টারিটি আছে আমেরিকার শিকাগোতে। স্টারবাকসের আউটলেট সংখ্যা তার প্রতিযোগী কোম্পানি ডানকি ডোনাট, টিম হরটন ও কস্টা কফির আউটলেটের চেয়ে অনেক বেশি। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকাতে তাদের অনেক আউটলেট রয়েছে। স্টারবাকস ফর্চুন ২০২৩ সালের বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত কোম্পানির তালিকায় খাদ্য পরিষেবা শিল্পে প্রথম স্থান এবং বিশ্বের ৬৪৫ টি কোম্পানির মধ্যে ১৪ তম স্থান অর্জন করেছে।

স্টারবাকসের কৌশলগত বৈশ্বিক সম্প্রসারণের উদাহরণ।

স্টারবাকসের কৌশলগত বৈশ্বিক সম্প্রসারণ তাদের সাফল্যের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। | ছবি সংগৃহীত।

স্টারবাকসের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্র্যান্ডিং অভিজ্ঞতা

সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্র্যান্ডিং মানে হল ইন-স্টোর অভিজ্ঞতা, পণ্য প্যাকেজিং এবং বিপণন যোগাযোগ সহ সমস্ত গ্রাহক টাচপয়েন্ট জুড়ে একটি ইউনিফাইড ব্র্যান্ড ইমেজ উপস্থাপন করা। স্টারবাকসের ব্যবসায়িক কৌশল একই দিকে ফোকাস করে এবং ক্রমাগতভাবে একটি উচ্চ-মানের অভিজ্ঞতা প্রদান করে যা গ্রাহকরা ব্র্যান্ড থেকে আশা করেন। সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্র্যান্ডিং অভিজ্ঞতা স্টারবাকসকে তার গ্রাহকদের সাথে একটি মানসিক সংযোগ তৈরি করে গ্রাহকের আনুগত্য গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। 

স্টারবাকস গ্রাহকদের সাথে যুক্ত হতে এবং ব্র্যান্ড সচেতনতা তৈরি করতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে। কোম্পানির একটি শক্তিশালী সামাজিক মিডিয়া উপস্থিতি রয়েছে এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম জুড়ে গ্রাহকদের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কোম্পানি নতুন পণ্য প্রদর্শন, ইভেন্ট প্রচার, এবং গ্রাহকের গল্প শেয়ার করতে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করে। এই ব্যস্ততা ব্র্যান্ডের আনুগত্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং গ্রাহকদের স্টারবাকসে ফিরে আসার সম্ভাবনা বাড়ায়।

“তথ্যসূত্র”

কিভাবে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে বিপ্লব ঘটাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

Previous article

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সফলতার পথে ‘বাটা’

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *