Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া |
আজকের দিনে প্রযুক্তি খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এই সময়ের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই -এর উদ্ভাবন। এআই সারা বিশ্বের জন্য অনেক নতুন সুযোগ তৈরি করছে কিন্তু একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হলো এমন একটি প্রযুক্তি যা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করে তোলে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন বলতে আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে আদালতে যেসব মামলা হয়, সেগুলোর সঙ্গে জড়িত আইনগুলোকে বোঝায়।
যেমন- কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি হলে তার উপর কার কতটা অধিকার থাকবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি ভুল তথ্য দেয় তাহলে তার জন্য কে দায়ী হবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘন হলে কী হবে, এই ধরনের সব প্রশ্নের উত্তর “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” আইনেই খুঁজতে হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন আমাদের জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে, তাই এ আই-কে নিয়ে আইন তৈরি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
গত ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ এ চেহারা শনাক্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে ৩৬ ঘণ্টার বেশি সময় বিতর্কের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য (ইইউ) দেশগুলোর প্রতিনিধি এবং আইনপ্রণেতারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন তৈরির বিষয়ে প্রাথমিক চুক্তিতে একমত হয়েছেন। এই যুগান্তকারী চুক্তির লক্ষ্য হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। গত ১৩মার্চ, ২০২৪-এ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আইন পাস করে।
প্রযুক্তির এত দ্রুত অগ্রগতি আমাদের কল্পনাকে ছাপিয়ে বহু দূর চলে গেছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন হয়ে উঠেছে একটি একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র, যেখানে পড়ানো হয় কিভাবে কম্পিউটার এবং সফটওয়্যার তৈরি করতে হয় যা বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করবে। তাই এআই-এর সঠিক ব্যবহারের জন্য সারা বিশ্বের দেশগুলোই নতুন নতুন আইন-কানুন তৈরি করছে।
কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন অপব্যবহার যেমন- এর ফলে বাড়ছে ডিপ ফেক ভিডিয়ো এবং ভয়েস ক্লোনিংয়ের মতো অপরাধমূলক কাজ। সেই কারণে বাংলাদেশে চালু হতে চলেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিমালা। এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ আইন চালু হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এই আইন প্রণয়নে কিছু বিলম্ব হচ্ছে।
এআই এর কিছু উল্লেখ্য সুবিধাজনক কাজ যেমন- এআই সিস্টেমগুলো চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সার নির্ভুলভাবে সনাক্ত করতে পারে, এআই দ্রুত ও প্রচুর পরিমাণে ডেটা প্রক্রিয়া করতে পারে এবং কিছু কর্মক্ষেত্রে প্রচুর সংখ্যা এবং তথ্য নিয়ে কাজ করে, যেমন- অর্থ এবং স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদিতে নির্ভুল ভাবে কাজ করে। এআই চালিত রোবটগুলি কারখানায় বিপজ্জনক বা পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো কমান্ড দিয়ে রাখলে নিজে নিজেই করতে পারে। এআই আইনি নথি পর্যালোচনা বা ভাষা অনুবাদ করার মতো কাজে এটি বেশ দক্ষ।
এছাড়াও অনলাইন স্টোরগুলিতে আপনার পছন্দের উপর ভিত্তি করে পণ্যগুলি সুপারিশ করতে পারে। এআই-চালিত চ্যাটবটগুলি বিরতিহীন ভাবে কাজ করে চব্বিশ ঘন্টা গ্রাহক পরিষেবা সরবরাহ করতে পারে। এআই ঔষধ এবং বিজ্ঞানের মত ক্ষেত্রগুলোতে গবেষণার গতি বাড়াতে সাহায্য করে থাকে। এআই পরিবেশ রক্ষা করতে, যেমন- দূষণের মাত্রা নিরীক্ষণ বা বিপন্ন প্রাণীদের ট্র্যাক করতে ব্যবহার করা হয়।
এআই কীভাবে আমাদের উপকার করতে পারে উপরে তার কয়েকটি উদাহরণ দেখলাম মাত্র। এআই এর অনেক সুবিধার সঙ্গে এর কিছু অপকারি দিকও রয়েছে। যেমন- এটির আপগ্রেডেড ভার্সন ব্যবহার করা ব্যয়বহুল হতে পারে, এছাড়াও এআই কিছুক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট। এআই কিছু চাকরি প্রতিস্থাপন এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এরকম আরো কিছু অপকারি দিক সম্পর্কে আমরা এখন জানবো-
বিশেষ হার্ডওয়্যার, সফ্টওয়্যার এবং প্রশিক্ষিত পেশাদারদের প্রয়োজনের কারণে এআই সিস্টেমগুলি বিকাশ করা ব্যয়বহুল হতে পারে। এছাড়াও এআই সিস্টেম তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উন্নত প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রয়োজন। আমাদের এআই দক্ষতার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট দক্ষ পেশাদার নেই। এআই সিস্টেমগুলো তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডেটাতে উপস্থিত পক্ষপাতগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে। এআই মডেলগুলি প্রায়শই তাদের মূল প্রশিক্ষণের বাইরে কাজগুলি সম্পাদন করতে কিছু চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির শিকার হয়। এআই নির্দিষ্ট কিছু পদের মানব কর্মীদের প্রতিস্থাপন হিসেবে কাজ করে থাকে এবং ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এআই সিস্টেম সাইবার আক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন একটি আইন তৈরি করেছে যা সারা ইউরোপে কম্পিউটার সুরক্ষা সম্পর্কে একই ধরনের নিয়ম তৈরি করার চেষ্টা করছে। ভারতও এমন একটি আইন তৈরি করেছে যা ভারতের ডিজিটাল শাসনের জন্য নতুন নিয়ম । এই আইনে কম্পিউটার সুরক্ষা, তথ্য গোপনীয়তা এবং এআই-এর নৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে বলা আছে। ভিয়েতনামও এমন একটি আইন তৈরি করেছে যা ভিয়েতনামের শাসন, অর্থনীতি এবং সমাজকে ডিজিটালভাবে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। এই আইনের মাধ্যমে ভিয়েতনামের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিশ্বের অন্য কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করার চেষ্টা করছে।
একইভাবে, আমাদের “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর স্বপ্ন সফল হবে কিনা, তা নির্ভর করে আমরা কতটা দক্ষতার সাথে এআই-এর জটিলতাগুলো পরিচালনা করতে পারি। বাংলাদেশে এআই-এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে আইন-কানুন তৈরি করা হবে, সেগুলোর মূল উদ্দেশ্য হবে নতুন নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিকাশের কারণে বিশ্ব দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশেরও এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের অংশ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই বাংলাদেশকে দায়িত্বের সাথে এআই ব্যবহার করার জন্য নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে। যেমন- আপনি এমন একটি ভবিষ্যৎ কল্পনা করুন যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ট্রাফিক পরিচালনায় সাহায্য করছে, কৃষিকাজকে উন্নত করছে এবং স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটিয়েছে।
এই ভবিষ্যৎ তখনই সম্ভব যদি বাংলাদেশ এমন কিছু নিয়ম-নীতি বা আইন তৈরি করে যা এআই এর অপব্যবহারকে রোধ করে দেশ এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে আরো সহজ ও সুন্দর করবে।
Comments