বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৩১, ২০২৪
কারেন্সীফিন-ইকোনমি

নতুন বাংলাদেশ ২.০-র আগের ও পরের মুদ্রা পরিস্থিতি

0

গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়শা মারিয়া

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ই আগস্ট পতন ঘটলো বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা এক স্বৈরাচারী সরকারের। জন্ম হলো এক নতুন বাংলাদেশের-“বাংলাদেশ ২.০” ।  সদ্য ক্ষমতাচ্যুত এ সরকার ১৮ লাখ ৩৫ হাজার  কোটি টাকা ঋণ রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এ সকল ঋণ নেওয়া হয়েছে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে।   

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে বেশ নাজুক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আশংকা করা হচ্ছে, আগামী ২০২৫ সালের জুন মাস নাগাদ বাংলাদেশে আমাদের জিডিপি’র গ্রোথ ৬.৬ শতাংশ হতে ৬ শতাংশেরও নিচে নেমে যেতে পারে।

মূল্যস্ফীতিকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নষ্ট হওয়ার মূল কারণ ধরা হচ্ছে। ২০২৪ এর জুলাইয়ের মূল্যস্ফীতি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১.৬৬ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। যেখানে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৪.১ শতাংশে। উদাহরণস্বরুপ- আপনি গত বছর যদি একটা পণ্য ১০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করে থাকেন তবে এ বছর সেই একই পণ্য আপনাকে ১১১.৬৬ টাকা দিয়ে ক্রয় করতে হবে। আবার গতবছর যদি আপনি ১০০ টাকায় কোনো খাবার কিনেন তবে এ বছর সেটির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪.১ টাকায়। যদিও খাদ্যমূল্য স্ফীতি বর্তমানে আগের থেকে কিছুটা কমে গেছে।   

ব্যাংকিং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করলে দেখা যাচ্ছে, যে ইসলামী ব্যাংকের অর্ধেকের বেশি ঋণ গিয়েছে এস আলম গ্রুপে-র কাছে। এস আলম গ্রুপ একদিকে ১৮ কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রার সমান টাকা সরিয়েছে। আবার ব্যাংক হতে ঋণের নাম করে ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার উপরে ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। আবার বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সালমান এফ রহমান এর বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারের জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লোপাট, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। এসব বিবেচনা করলে বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব একটা স্থিতীশীল অবস্থায় নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ও অধ্যাপক কুনাল সেন (ইউ এন ইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স রিসার্চের ডিরেক্টর) এমন নড়বড়ে অর্থনৈতিক অবস্থা সমাধানের জন্য কিছু উপায় বলেছেন, তার মধ্যে রয়েছে-

১। মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। ২। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করা। ৩। খেলাপি ঋণ উদ্ধার। ৪। গার্মেন্টস শিল্পের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা।  

এবার বাংলাদেশের বর্তমান মুদ্রা পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

মুদ্রাস্ফীতির হার বিশ্লেষণঃ

যখন কোনো দেশে মূদ্রাস্ফীতির চাপ অনেক বেশি থাকে তখন অর্থনীতিবীদরা বলেন দেশে সুদের হার বাড়িয়ে বা এই সুদের হারকে বাজার ভিত্তিক করে দিতে হবে। অর্থাৎ যদি কেউ লোন নিতে যায়, তবে ব্যাংক সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেয় এবং এর কারণে লোকজন লোন কম নেওয়া শুরু করে এতে করে মানি সাপ্লাই কমে যায়। নিচে সিপিআই দ্বারা পর্যবেক্ষিত আগস্ট ২০২৩ হতে আগস্ট ২০২৪ এর মুদ্রাস্ফীতির হার দেখতে পাই।    

গ্রাফ 2023 সালের এপ্রিল থেকে CPI দ্বারা পরিমাপ করা মুদ্রাস্ফীতির হারকে চিত্রিত করে, মুদ্রার অবস্থার পরিবর্তনগুলিকে চিত্রিত করে।

2023 সালের এপ্রিল পর্যন্ত মুদ্রার অবস্থা প্রতিফলিত করে মুদ্রাস্ফীতির হারের প্রবণতা। | ছবি: সংগৃহীত

আগস্ট ২০২৩ এ মূদ্রাস্ফীতির হার ৯.৯২ ছিল এবং ২০২৪ এর জুলাই এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ১১.৬৬। তবে অন্তর্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুদ্রাস্ফীতির হার ১১.৬৬ হতে ১০.৪৯ এ হ্রাস পেয়েছে যা একটি ইতিবাচক দিক বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকিং অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে ব্যবসায়ী ব্যাংকগুলি আন্ত:ব্যাংক এবং গ্রাহকের লেনদেনের জন্য চাহিদা এবং যোগানের ভারসাম্য অনুযায়ী টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ করে । বাজারের অবস্থার ভারসাম্য বজায়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত আন্ত:ব্যাংক বিনিময় হারে ব্যবসায়ী ব্যাংকের সাথে ডলার কেনা-বেচা করে।  

সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক নিম্ন হারে ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেন এর বিনিময় করে। নিচে আন্ত:ব্যাংক এ ইউএস ডলার ও  বাংলাদেশি টাকার ক্রয়-বিক্রয়ের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বিনিময় হার দেখানো হয়েছে। অন্যান্য বিদেশী মুদ্রার সাথে বাংলাদেশি কারেন্সির ক্রস রেটগুলি নির্ভর করে NY এবং ঢাকা ক্লোজিং বিনিময় হারের উপর।

15 সেপ্টেম্বর, 2024 তারিখের ক্রস রেটের সারণী, মুদ্রার অবস্থা এবং বিনিময় হারের চিত্র তুলে ধরে।

15 সেপ্টেম্বর, 2024 পর্যন্ত মুদ্রার অবস্থা প্রতিফলিত করে ক্রস রেট ওভারভিউ। | ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক সুদের হারঃ

 (২০২৪ এর জুলাইয়ের আগে এবং আগস্টের পরের পরিস্থিতির তথ্য থেকে বিশ্লেষণ)

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত মাসিক সুদের হার দেখানো চার্ট।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত মাসিক সুদের হার। | ছবি: সংগৃহীত

টেবিলটিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারী থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য ব্যাংকে দেওয়া সুদের হার ৪ শতাংশই নির্ধারিত রয়েছে দেখা যাচ্ছে এবং আন্তঃব্যাংকের মধ্যকার গড় লেনদেন প্রতিবারে সুদের হার একইরকম নির্ধারিত ছিলো। ব্যাংক গুলোর গড় আমানত ও অগ্রিম এর সুদের হার বিবেচনা করলে দেখা যায়, এ বছর জানুয়ারীতে ব্যাংকের মুনাফার হার ছিলো ৪.৮৩ এবং জুলাই এ ছিলো ৫.৮৯। এ থেকে বোঝা যায় যে, মুদ্রাস্ফিতী বাড়লে আমানতের হার কমে যায়, আর কমলে আমানতের হার বেড়ে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি কমানোর একটি পদ্ধতি হলো আমানতের উপর মুনাফার হার বৃদ্ধি করা যাতে জনগনের হাতে টাকা কমে যায়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভঃ

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং কারেন্সি স্টেট দেখানো চার্ট।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং কারেন্সি স্টেটের ওভারভিউ। | ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এর দিকে নজর দেয়া গেলে জানা যায়, ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ মে ২০২৪ এ কমে ১৮বিলিয়নে নেমে গেছে। তবে এখন ফরেন রিজার্ভ ২০.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। তবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এর থেকে লোনও নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে নড়েচড়ে গেছে বেশ ভালো ভাবেই তা বোঝা যাচ্ছে আর এর পেছনে বিগত সরকারকে দুর্নীতিতে নোবেল পুরস্কার দিলেও মন্দ হয় না।   

রেমিট্যান্স প্রবাহঃ

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার পেছনে সব থেকে বড় কারণ হলো প্রবাসী আয় এবং রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি- জানিয়েছে  বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে এখন ২ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে এটি ২ হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি”। তিনি আরো জানান, ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেন সক্রিয় থাকার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার এখন স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যা আমরা নিচে প্রদানকৃত তথ্য থেকে জানতে পারি।

2023-2024 এর জন্য মজুরি উপার্জনকারীর রেমিট্যান্সের মাসিক ডেটা চিত্রিত গ্রাফ, মুদ্রার অবস্থা প্রতিফলিত করে।

মাসিক মজুরি উপার্জনকারীর রেমিট্যান্স ডেটা মুদ্রার অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। | ছবি: সংগৃহীত

জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে প্রবাসী আয় বাড়ার কারণে রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে। বিভিন্ন সংকট কাটতে শুরু করায় ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের ডলার কেনাবেচা করতে পারছে। বর্তমানে ডলারের দাম ১১৮-১২০ টাকার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেল ও কার্ব মার্কেটে ডলারের দামের পার্থক্য এখন ১ শতাংশেরও কম’।

 তথ্যসূত্র 

বাংলাদেশি টাকার ইতিহাস: জাতির অর্থনৈতিক প্রতীক

Previous article

কর্মজীবনে নিজেকে চাপমুক্ত রাখবেন যেভাবে

Next article

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পপুলার পোস্ট'স