গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা ইসফাকুল কবির
বিল গেটস এবং স্টিভ জবস — দুইজনই প্রযুক্তি জগতের আইকন। তবে তাদের সম্পর্ক একসময় বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতায় রূপান্তরিত হয়েছিল। জবসের অ্যাপল ও বিলের মাইক্রোসফটের মধ্যকার প্রতিযোগিতা প্রযুক্তিবিশ্বে সর্বকালের সেরা প্রতিযোগিতা বলে মানা হয়। দুজনের মধ্যে বন্ধু ভাবাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিযোগিতায় রুপ নেয় ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে তাদের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে, কীভাবে তারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দুই কোম্পানি তৈরি করলেন।
বন্ধুত্বের শুরু
বিল গেটস এবং স্টিভ জবস প্রথমবার দেখা করেন ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে, যখন মাইক্রোসফট এবং অ্যাপল ছিল দুটো ছোট স্টার্ট-আপ। স্টিভ জবস তখন নতুনভাবে তৈরি করা অ্যাপল কম্পিউটারের সফটওয়্যারের জন্য মাইক্রোসফটের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। গেটস সেই সময় অ্যাপল ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করছিলেন। দুজনের মধ্যে তখন ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং তারা একসাথে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের স্বপ্ন দেখতেন।
তবে এর আগে দুইজনের জীবন ছিল পুরোটায় আলাদা। ১৯৫৫ সালে আমেরিকার দুই প্রান্তে তাদের জন্ম। বিল ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান অন্যদিকে স্টিভকে একটি পরিবার দত্তক নেয়। তবে স্টিভের পরিবার খুব একটা ধনী ছিল না। বিল তার পড়াশোনার জন্য ভালো স্কুল কলেজ এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পান। পরবর্তীতে বিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়াশোনা ছেড়ে দেন তার নিজের প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে কারণে।
অন্যদিকে স্টিভের জীবন ততটা সাবলীল ছিল না, সে রিড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও আর্থিক কারণে তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তিনি খাবারের জন্য পরে থাকা কোকের ক্যানও কুড়িয়েছেন এবং সপ্তাহে একদিন তিনি ফ্রিতে খাবার পেতেন তার এলাকার কৃষ্ণা মন্দিরে। পরবর্তীতে তিনি “হ্যাপি জেনারেশন” এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন এবং সাত মাস পর আবার আমেরিকাতে ফেরত এসে নিজের বিজনেস শুরু করেন।
বিল এবং স্টিভ মিলে অ্যাপল টু বাজারে আনে। এক্ষেত্রে বিল অ্যাপলের জন্য সফটওয়্যার তৈরিতে সাহায্য করেছিলো। অ্যাপল টু প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ কিনেছিলো। সে সময় এটি ব্যবহার করা এতোটাই সহজ ছিল যে ক্রেতারা শুধু বক্স থেকে বের করেই এটি ব্যবহার করা শুরু করে দিতে পারতেন। এতেই বিল এবং জবস অনেক টাকার মালিক হয়ে যান।
স্টিভের কাজের ধরনের মধ্যে একটু ভিন্নতা ছিল। তিনি তার কোম্পানির সকল পণ্য একই সুতায় গেঁথে নেয়। যেমন আপনি চাইলেই অ্যাপল পণ্য অন্য কোনো কোম্পানির সফটওয়্যার দিয়ে চালাতে পারবেন না। এমনকি অ্যাপল পণ্য খুলতে আপনার অ্যাপল তৈরি ভিন্ন আকৃতির যন্ত্রের ব্যবহার করতে হবে। যে ব্যাপারটি ছিল প্রযুক্তির জগতের একদম অন্যরকম । অন্যদিকে বিল তার পণের বিশিষ্টে ছিলেন সাদা-মাটা, তার পণ্য যে কোনো কম্পিউটারের জন্য উপযুক্ত করে তিনি তৈরি করে তোলেন।
শত্রুতার শুরু
১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে তাদের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। অ্যাপল এবং মাইক্রোসফট উভয়েই নিজেদের অপারেটিং সিস্টেমকে শীর্ষে নিয়ে যেতে চাইছিল। জবস মনে করতেন যে গেটস তার আইডিয়া চুরি করেছেন, বিশেষত মাইক্রোসফট উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম যখন বাজারে আসে। এই কারণে তাদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং জবস তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেন। এই প্রতিযোগিতা তাদের বন্ধুত্বকে ধীরে ধীরে শত্রুতায় রূপ দেয়।
অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের বিশাল সাফল্য
জবস তার কোম্পানির নতুন পণ্য “অ্যাপেল লিজার জন্য বিলকে প্রোগ্রামিং লিখতে বলেন। বিল বলেন, আমি কাজটা করতে রাজি আছি কিন্তু আমার এটির প্রোটোটাইপ লাগবে। মানে পণ্যটির ওরিজিনাল কপি লাগবে। জবস অ্যাপেল লিজার জন্য বেশ বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেন কিন্তু মাত্র ১০ হাজার মানুষ এটি কিনেছিল। তখনই বিল ভাবে আবার আমার নিজের পণ্য বাজারে আনতে হবে। তাই তিনি বাজারে নিয়ে আসেন উইন্ডোজ ওয়ান পয়েন্ট জিরো। আর তাতেই বেকে বসেন জবস, তার দাবি বিল তার সিস্টেম চুরি করেছে। এখান থেকেই শুরু তাদের দুইজনের মাঝে শত্রুতা। পরবর্তীতে বিভিন্ন করণে স্টিভ জবসকে তার নিজের কোম্পানি থেকে নিজেকেই চলে যেতে হয়।
অন্যদিকে বিলের জীবন বেশ ভালো কাটছিলো। ১৯৮৭ সালে মাত্র ৩১ বয়সে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী বিলিয়নিয়ার হন। তার কোম্পানি একের পর এক রেকর্ড ভাঙ্গতে থাকে। দেখতে দেখতে ১৯৯৫ দালে বিল বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিতে রূপান্তর হন।
এদিকে জবস তার নতুন কোম্পানি নেক্সট তৈরির চেষ্টা করছিলেন। পর্দার ওপাশে জবসের প্রাক্তন অ্যাপেল সফলতার দেখা পাচ্ছিলো না। তাই ১৯৯৭ সালে অ্যাপেল সিদ্ধান্ত নেয় যে স্টিভ জবসকে তারা আবার ফিরিয়ে আনবে। এবং অ্যাপেল স্টিভের নেক্সট কিনে নেয় ৪২৯ মিলিয়ন ডলার দিয়ে। এরই সাথে স্টিভ তার প্রাক্তন অ্যাপেলর কাছে ফিরে আসে। কিন্তু ১৯৯৭ সালে অ্যাপেল যখন দেউলিয়া হওয়ার পথে তখন বিল ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে স্টিভের কোম্পানিতে।
এবার সময় আসে স্টিভের জাদু পুরো দুনিয়াকে দেখানোর। তিনি অ্যাপেলর নতুন পণ্য বাজারে আনেন। যার নাম ছিল “আইম্যাক” এবং যা ছিল অসাধারণ সাফল্য। স্টিভ এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০১ সালে অ্যাপেল নিয়ে আসে “আইপড”, যা ছিল রেভ্যুলুশন মিউজিক লাভারদের জন্য। এরি প্রেক্ষিতে মাইক্রোসফট নিয়ে আসে “জুম মিডিয়া প্লেয়ার”, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।
আবারও অ্যাপেল তাদের প্রথম আইফোন বাজারে এনে পুরো দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়। মাইক্রোসফট তাদের নিজেদের অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে নতুন ফোন বাজারে আনে তবে তা ছিল তাদের ব্যর্থ চেষ্টা।
বন্ধুত্বের শেষ অধ্যায়
যদিও তাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে শত্রুতা চলেছিল, স্টিভ জবসের মৃত্যুর কিছু বছর আগে তারা আবারও তাদের সম্পর্ক ভালো করের চেষ্টা করে। ২০০৭ সালে বিল গেটস এবং স্টিভ জবস একসঙ্গে একটি টিভি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন, যেখানে তারা তাদের পুরোনো দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন এবং একে অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। জবস গেটসের ধৈর্যশীলতার প্রশংসা করেন, এবং বলেন, “বিল গেটস একজন চমৎকার ব্যবসায়ী।” অপরদিকে, বিল গেটস জবসের উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রশংসা করে বলেন, “স্টিভ ছিল একজন দক্ষ ডিজাইনার এবং তার সাহসিকতা ছিল অবিশ্বাস্য।”
স্টিভ জবসের মৃত্যুর পর বিল গেটসের প্রতিক্রিয়া
স্টিভ জবসের মৃত্যুর পর বিল সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে স্টিভ জবসকে ‘জিনিয়াস’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, তিনি অ্যাপলের কিংবদন্তি জবসের প্রতিভার কারণে তিনি ঈর্ষা করতেন। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, “স্টিভ জবস মানুষকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ জাদুকর ছিলেন।” বিল এটাও বলেন যে, স্টিভ অ্যাপলে ফিরে আসার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
বিল গেটস এবং স্টিভ জবসের সম্পর্ক ছিল জটিল। বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতা এবং পরে পুনর্মিলন। অ্যাপল ও মাইক্রোসফট আজকের টেক বিশ্বে যে বিপ্লব এনেছে, তা শুধু তাদের প্রতিভারই ফল নয়, বরং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই উদ্ভূত। নব্বই দশকের মানুষ গুলো আজও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বলতে বিল গেটস কেই জানে। এতে বোঝা যায় পুরো বিশ্বে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন বিল। অন্যদিকে অ্যাপল আজও স্টিভ জবকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করে তার আবিষ্কারের জন্য।
Comments