গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আনিকা তায়্যিবা
আপনি কি বিশ্বাস করবেন যদি বলা হয় এক প্যাকেট পাউরুটি কেনার জন্য একটি দেশে মানুষকে ব্যাগ ভর্তি ব্যাংকনোট বহন করতে হত? ১৯৮০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময়টায় জিম্বাবুয়েতে এই অবস্থাই বিদ্যমান ছিল। জিম্বাবুয়ে ডলারের দীর্ঘ ইতিহাস অতিমুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক দুর্যোগ এবং ভুল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর জিম্বাবুয়ের মুদ্রা ক্রমাগত পরিবর্তন ও পুনঃমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে গেছে। একসময় দেশের গর্ব থাকলেও, ১৯৮০ সালে রোডেশিয়ান ডলারের পরিবর্তে চালু করা জিম্বাবুয়ে ডলার দেশের অর্থনীতিতে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৯৮০–২০০৯: স্বাধীনতা-পরবর্তী জিম্বাবুয়ে ডলারের সূচনা এবং সংকট
১৯৮০ সালে স্বাধীনতার পর দেশে জিম্বাবুয়ে ডলার চালু করা হয়। প্রথম সিরিজের নোটগুলির মধ্যে ২ ডলার থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত মূল্যমান ছিল । কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমতে শুরু করে, এবং ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ৫০০ ডলার এবং ১০০০ ডলারের নোট জারি করা হয়। ২০০৭–২০০৮ সালে, জিম্বাবুয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতিতে পতিত হয়। এমনকি তখন দৈনন্দিন সামগ্রীর দাম মিলিয়ন জিম্বাবুয়ে ডলারে পরিণত হয়েছিল।
অতিমুদ্রাস্ফীতির মোকাবিলা করতে তখন জিম্বাবুয়ে ডলারের একাধিক পুনর্মূল্যায়ন হয়। ২০০৬ সালে “অপারেশন সানরাইজ” নামক প্রথম পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। তবে এতেও মুদ্রাস্ফীতি পূর্বের মতই থাকে। ফলে, ২০০৯ সালে সরকার একটি তৃতীয় পুনর্মূল্যায়ন ঘোষণা করে, যেখানে দেশটি এক ট্রিলিয়ন জিম্বাবুয়ে ডলার বাজারে আনে। মুদ্রা ও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার এটি শেষ প্রচেষ্টা থাকলেও এটিও শেষমেশ ব্যর্থ হয়।
বহুমূল্য মুদ্রা ব্যবস্থা
জিম্বাবুয়ে ডলারের এই দূর্দশার পর, জিম্বাবুয়ে একটি বহুমূল্য মুদ্রা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যেখানে বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রা স্থানীয় মুদ্রার পাশাপাশি বৈধ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হত। এর মধ্যে বোতসোয়ানা পুলা, ভারতীয় রুপি, ইউরো, ইউএস ডলার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা র্যান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ফলে, ইউএস ডলার দ্রুত দেশের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মুদ্রা হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকার বন্ড নোটও চালু করে, যা ইউ এস ডলারের সাথে ১:১ হারে বিনিময়যোগ্য ছিল।
জিম্বাবুয়ে ডলারের পুনঃপ্রবর্তন
জুন ২০১৯ সালে, জিম্বাবুয়ে রিজার্ভ ব্যাংক বহুমূল্য মুদ্রা ব্যবস্থা স্থগিত করে এবং জিম্বাবুয়ে ডলার পুনঃপ্রবর্তন করে। তবে আভ্যন্তরীন সমস্যার কারণে ২০২০ সালে পুনরায় বহুমূল্য মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করা হয়।
জিম গোল্ড মুদ্রা প্রচলন
পরবর্তীকালে, জিম্বাবুয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুনভাবে “জিম গোল্ড” মুদ্রা চালু করে, যা সোনা দ্বারা তৈরি। এর লক্ষ্য ছিল উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করা এবং দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করা। নতুন এই মুদ্রা সোনা এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর দ্বারা তৈরি । যা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে বাজারে আনা হয়েছে।
মুদ্রার মান স্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, তা সত্ত্বেও জিম্বাবুয়ের মুদ্রাস্ফীতি সমস্যা এখনও বিদ্যমান। ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, জিম্বাবুয়ের গড় মুদ্রাস্ফীতি হার ছিল প্রতি বছর ৬৭২.৫%, যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। ২০২২ সালের হিসাবে দেশের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি হার প্রায় ১০৪% ছিল, যা ২০২০ সালের বিপজ্জনক ৫৫৭% থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। তবে জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি এখনও অস্থিতিশীল।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে হওয়া এই মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জিম্বাবুয়ে ডলার একসময় অন্যতম মূল্যবান মুদ্রা হিসেবে পরিচিত থাকলেও, অতিমুদ্রাস্ফীতির কারণে এটি বর্তমানে সবচেয়ে কম মূল্যবান মুদ্রাগুলির একটি।
বর্তমান অবস্থা এবং এখনকার জিম্বাবুয়ের মুদ্রা
বর্তমানে, জিম্বাবুয়ের আনুষ্ঠানিক মুদ্রা আরটিজিএস ডলার (জিম্বাবুয়ের নতুন মুদ্রা)। ২০২০ সালের মার্চ মাসে, জিম্বাবুয়ে সরকার এই নতুন জিম্বাবুয়ে ডলার চালু করে। এটির ১ ডলার থেকে ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০ এবং ৫০০ ডলারের নোট পাওয়া যায়। সরকার নতুন “জিম্বাবুয়ে ডলার নিলাম ব্যবস্থা” ও চালু করে, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হারে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের জন্য বিদেশি মুদ্রার নিলাম করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা।
তবে, কালোবাজারে মুদ্রা বিনিময় এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। সরকার মাঝে মাঝে এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার চেষ্টা করলেও এটি বন্ধ হয়নি। যা জিম্বাবুয়ের মুদ্রার স্থিতিশীলতার পথে বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
জিম্বাবুয়ে ডলারের ইতিহাস এক চরম অস্থিতিশীলতা এবং অতিমুদ্রাস্ফীতির অধ্যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে, জিম্বাবুয়ে এখনও দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পুনর্গঠনের জন্য লড়াই করছে, কিন্তু এর মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা এখনও অমীমাংসিত থেকে গেছে। যদিও জিম গোল্ড ও আরটিজিএস ডলার চালু করে দেশটি আর্থিক স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা করছে, তবে এটি কতটা কার্যকর হবে তা এখন সময়ই বলবে।
Comments