Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আনিকা তায়্যিবা |
স্বর্ণ বললেই মাথায় আসে নারীদের অলঙ্কারের বস্তু। তবে কেবল গয়না গড়ানোর ক্ষেত্রেই নয়, প্রাচীনকাল থেকে ধন-সম্পদের প্রদর্শন এবং অর্থনৈতিক লেনদেনে ব্যবহার হয়ে আসছে স্বর্ণ। স্বর্ণকে বলা হয় সবচেয়ে স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য সম্পদ, যার ঔজ্জ্বল্য, দুষ্প্রাপ্যতা এবং স্থায়িত্বের কারণে এটি কখনো তার মূল্য হারায় না। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে স্বর্ণে বিনিয়োগ একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত হতে পারে।
আগে জেনে নিই কতভাবে স্বর্ণ বিনিয়োগ করা যেতে পারে-
স্বর্ণে বিনিয়োগ করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে, হতে পারে তা গয়না গড়িয়ে রাখার মাধ্যমে বা সলিড স্বর্ণের বার কিনে, এর মাধ্যমে স্বর্ণের সরাসরি মালিকানা লাভ করা যায়। অথবা স্বর্ণ বাজারজাত করে এমন কোম্পানির শেয়ার কিনেও স্বর্ণে বিনিয়োগ করা যায়।
কিন্তু স্বর্ণে কেন বিনিয়োগ করবেন, এর পেছনে কিছু যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। স্বর্ণ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়—কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও আর্থিক ঝুঁকি হ্রাস এবং সম্পদ সংরক্ষণের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার করে থাকে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে ব্যবসাগুলো যে ঝুঁকির মুখে পড়ে, তা সামলাতে স্বর্ণ একটি নিরাপদ ও কার্যকর সম্পদ।
এছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে, যথা-
১. মুদ্রাস্ফীতি থেকে সুরক্ষাঃ
মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, সর্বোপরি অর্থনীতির জন্য বেশ বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এটি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে আনে। স্বর্ণকে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ঢাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ যখন মুদ্রার মূল্য হ্রাস পায়, তখন স্বর্ণের মূল্য বাড়ে। ফলে ব্যক্তি বা ব্যবসাগুলো তাদের নগদ মূলধনের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে।
২. অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে স্থিতিশীলতাঃ
অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালে মুদ্রার দাম কমলেও সমানুপাতিক হারে বাড়ে স্বর্ণের চাহিদা। অর্থনৈতিক মন্দা বা ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার সময়ে তাই স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তাই স্বর্ণ বাজারের অস্থিরতার প্রভাব থেকে ব্যবসাগুলোকে রক্ষা করে। ব্যবসা ক্ষেত্রে বা ব্যক্তি উদ্যোগে স্বর্ণে বিনিয়োগ করলে তাই আর্থিক ক্ষতি সীমিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সহজ হয়।
৩. বিনিয়োগের সহজলভ্যতাঃ
স্বর্ণে বিনিয়োগ করা তুলনামূলক ভাবে সহজ, কেবল খাঁটি স্বর্ণ বাছাই করে তাতে বিনিয়োগ করতে হয়। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য স্বর্ণে বিনিয়োগ করা একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এছাড়া দিন দিন অন্যান্য দ্রব্যপণ্যের দাম ওঠা নামা করলেও স্বর্ণের দামে তেমনটা দেখা যায়না। বরং বৈশ্বিক বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি পেতেই থাকে।
৪.মুদ্রার মূল্য হ্রাস করলেও স্বর্ণে এর প্রভাব পড়েনাঃ
বৈশ্বিক বাজারের ব্যবসাগুলোতে মুনাফা প্রায়ই ওঠানামা করে। স্থানীয় বা বৈদেশিক মুদ্রার মান কমে গেলে তা ব্যবসার নগদ প্রবাহ ও মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বর্ণকে এই ক্ষেত্রে দেখা হয় মুদ্রা্র উপর অনির্ভরশীল সম্পদ হিসেবে। অর্থাৎ দেশীয় মূল্যের মান ওঠানামায় এই সম্পদ ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। মুদ্রার মান কমে গেলেও এসময় স্বর্ণে বিনিয়োগ করা ব্যবসাগুলো তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে।
তবে এতসব সুবিধার মাঝেও রয়েছে কিছু ক্ষতিকর দিক, যা বিনিয়োগের আগে বিবেচনায় রাখা জরুরি । যেমনঃ
- মূল্য ওঠানামা: স্বর্ণের মূল্য বাজার পরিস্থিতি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিনিয়োগকারীদের মনোভাবের উপর নির্ভর করে দ্রুত ওঠানামা করতে পারে।
- আয়বিহীন সম্পদ: শেয়ার বা বন্ডের মতো স্বর্ণ থেকে সরাসরি কোনো আয় হয় না। কেবল মূলধন মূল্যবৃদ্ধি থেকেই মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
- সংরক্ষণ ব্যয়: স্বর্ণ সংরক্ষণে নিরাপত্তা এবং বীমা খরচ জড়িত, যা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
স্বর্ণের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, অন্যান্য সম্পদের তুলনায় যুগে যুগে স্বর্ণের চাহিদা ও মূল্য দুটোই অতি দ্রুত বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল, যা এর মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ২০২২ সালের মার্চে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়ে ২,০৪৩ মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। ২০২০ সালের করোনা মহামারিতেও স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ ২,০৭০ মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। এই ধরণের বৈশ্বিক সংকটে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ে এবং এর মূল্য স্থিতিশীল থাকে, যা নিঃসন্দেহে টাকা বিনিয়োগ করা যায় এমন যেকোনো ব্যবসার চাইতে লাভজনক। চাহিদা এবং সরবরাহের ভারসাম্য সর্বদা বজায় থাকায় স্বর্ণ কখনো তার সম্পূর্ণ মূল্য হারায় না।
বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান অনিশ্চয়তার সময়ে, স্বর্ণে বিনিয়োগ হতে পারে একটি যৌক্তিক ও নিরাপদ সমাধান, যা ব্যবসার ভবিষ্যৎকে আরও টেকসই এবং স্থিতিশীল করে তুলতে পারে। তেমনি ব্যক্তি ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকে লাভজনক করে তুলবে।
Comments