কোম্পানি ফরেনসিকস

বিমানের ইঞ্জিন থেকে লাক্সারি গাড়ি নির্মাতা বিএমডাব্লিউ

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিমানের ইঞ্জিন তৈরি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন বিশ্বের অন্যতম গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএমডাব্লিউ। পরবর্তীতে কোম্পানিটি দুইটি বিশ্ব যুদ্ধেই ইঞ্জিন ও গাড়ি সরবারাহ করেছিল জার্মানিকে। যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি একেবারে বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। সেই ধ্বংস স্তুপ থেকে উঠে এসে বিএমডাব্লিউ  এখন ৬০ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি।

বিএমডাব্লিউ এর যার অর্থ হলো বেভারিয়ান মোটর ওয়ার্কস। ১৯১৩ সালের অক্টোবার মাসে কার্ল ফেডেরিক র‍্যাপ এর হাত ধরে র‍্যাপ মোটর এন্ড ওয়ার্কা নামে যাত্রা শুরু করে বিএমডাব্লিউ।

ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার প্রতি র‍্যাপের ছিলো অদম্য আগ্রহ এবং ১৯০৮ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত তিনি জাস্ট অটোমোটিভ কোম্পানিতে চাকরি করেন। পরবর্তীতে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফ্লোগার্ক ডাচল্যান্ডের একটি ব্রাঞ্চ প্রধানের দায়িত্ব নেন। যখন ফ্লোগার্ক ডাচল্যান্ডে কোম্পানিটি একেবারে বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। তখন কার্ল র‍্যাপ এবং তার পার্টনার জুলিয়ার অসপিটাইজার মিলে সকল ধরনের ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচার করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় মাত্র ২ লক্ষ জার্মান কারেন্সি দ্বারা।

সে সময় আসন্ন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ফলে র‍্যাপ বিমানের এর জন্য ইঞ্জিন তৈরি শুরু করেন। তার তৈরি ইঞ্জিনগুলোতে কিছু গঠনগত ত্রুটির কারণে তিনি এই ধাক্কায় সফলতার দেখা পাননি।

অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে সে সময় কার্ল র‍্যাপের কোম্পানিটি প্রায় বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। প্রুশিয়ান আর্মিদের জন্য ৬০০ বিমানের ইঞ্জিনি তৈরির অর্ডার পেতেই আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে র‍্যাপ।

র‍্যাপ, ফ্যাংক জোসেফ পপ এবং তার ফ্যাইনান্সিয়াল পার্টনারের সাথে মিলে একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম  দেয়া হয়  “বিএফডাব্লিউ” । পরবর্তীতে বিএফডব্লিউ এর নাম পরিবর্তন করে বর্তমান বিএমডাব্লিউ রাখা হয়। সে বছরই কোম্পানিটি তাদের বহুল পরিচিত লোগো উন্মোচন করে। ২০১৮ সালে কোম্পানিটিকে জার্মান শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বিএমডাব্লিউ কোম্পানির ছবি - বিলাসবহুল গাড়ি ও প্রযুক্তির প্রতীকী চিত্র।

বিলাসবহুল গাড়ি ও আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন – বিএমডাব্লিউ কোম্পানির প্রতীকী ছবি। | ছবি: সংগৃহীত।

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষে জার্মানি ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে মিত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে কপাল পুড়ে বিএমডাব্লিউ। এই চুক্তিতে বলা হয় জার্মানি বিমানের জন্য কোন ইঞ্জিন তৈরি করতে পারবেনা। তারপর  তারা রেলের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি মনোযোগ দেয়। ১৯২৩ সালে প্যারিস মোটর শো তে কোম্পানিটি তাদের প্রথম মোটরসাইকেল প্রদর্শন করে। এটি ছিল তাদের জন্য প্রথম সম্পূর্ণ নিজেদের তৈরি কোন যান, এর আগে তারা বিভিন্ন যানবাহনের জন্য ইঞ্জিন তৈরি করতো।

কোম্পানিটি তাদের প্রথম গাড়ি তৈরি করে ১৯২৯ সালে, বিএমডাব্লিউ ৩১৫ নামে। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে শুরু করে। ১৯৩২ সালে কোম্পানিটি বিএমডাব্লিউ ৩০৩ নামে নতুন একটি মডেল বাজারে আনে যার ডিজাইন থেকে ইঞ্জিন সব কিছুই তাদের তৈরি ছিল।

বিএমডাব্লিউ ৩০৩ মডেল - বিএমডাব্লিউর প্রথম ছয় সিলিন্ডারযুক্ত ক্লাসিক গাড়ির ছবি।

বিএমডাব্লিউ ৩০৩ – বিএমডাব্লিউর প্রথম ছয় সিলিন্ডারযুক্ত ক্লাসিক গাড়ি, যা কোম্পানির ঐতিহ্যের সাক্ষী। | ছবি: সংগৃহীত।

১৯৩৩ সালে আডলফ হিটলার জার্মানির সিংহাসনে বসার শুরুতে বিএমডাব্লিউ  শুধু ইঞ্জিন, মোটরসাইকেল ও গাড়ি ম্যানুফ্যাকচারিং বাদেও একটি অস্ত্র তৈরি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অস্ত্র তৈরির কাজে জার্মান সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান সেনা দের অস্ত্র সরবরাহ করার দায়ে যুদ্ধ শেষে মিত্র বাহিনী বিএমডাব্লিউ’র সকল কারখানা বন্ধ করে দেয়। একেবারে দেউলিয়া হবার ঠ্যাকাতে প্রতিষ্ঠানটি রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রকার পণ্য তৈরি শুরু করে। 

পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে বিএমডাব্লিউ তাদের R-23 মডেলের পরিবর্তে বাজারে নিয়ে আসে R-24 মোটরসাইকেল। ১৯৫১ সালে কোম্পানিটি বিএমডাব্লিউ ৫০১ নামে তাদের প্রথম গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে। গাড়িটি সমাজের এলিট শ্রেণির মানুষদের টার্গেট করে বানালেও তা আশান্রুপ বিক্রি হয়নি। কোম্পানিটির পণ্য গুলো ভালো মানের হলেও অরিতিক্ত দামের জন্য তা ব্যবসা সফল হতে পারছিলনা। সে সময় বিএমডাব্লিউ অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মারসিডিজ বেঞ্জ কোম্পানিটিকে কিনে নিতে চায়। বিক্রির হাত থেকে বাঁচাতে জার্মানির উদ্যোক্তা হার্বাট কোয়ান্ট কোম্পানিটির বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নিলে তাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো হয়।

বিএমডাব্লিউ ৫০১ মডেল - ক্লাসিক ডিজাইনের বিলাসবহুল সেডান গাড়ির ছবি।

বিএমডাব্লিউ ৫০১ – ক্লাসিক স্টাইল ও বিলাসিতার মেলবন্ধন, বিএমডাব্লিউর প্রথম পোস্টওয়ার সেডান মডেল। | ছবি: সংগৃহীত।

এরপর তারা তাদের ৭০০ সিরিজের গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানিটি বাজারে নিয়ে আসে ১৫০০ মডেলের গাড়িও নতুন ধারার মোটরসাইকেল। ১৯৬২ সালে বিএমডাব্লিউ তাদের নিউ ক্লাসের লাইনাপের সেটআপের কম্প্যাক্টএর গাড়ি বাজারে আনে। এই লাইনআপের মাধ্যমেই কোম্পানিটি মূলত বর্তমান স্পোর্টস কার তৈরি সম্ভাবনা খুজে পায়। ১৯৬৮ সালে বিএমডাব্লিউ তাদের নিউ ৬ সিটেন গাড়িগুলো বাজারে আনে যার মধ্যে ই-নাইন মডেলের গাড়িও। যা প্রায় ৩০ হাজার পিস বিক্রি হয়। ১৯৭৬ সালে কোম্পানিটি ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে সিরিজ-৬ মডেলের গাড়ি বাজারে আনে।

সেই সময় বিভিন্ন কার রেসিং প্রতিযগিতায় চালকরা বিএমডাব্লিউ তৈরি গাড়ি ব্যবহার করে বেশ সাফল্য পায়। যার প্রেক্ষিতে বিএমডাব্লিউর তৈরি গাড়ি ফরমুলা-১ ও  ফরমুলা-২ কার রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে শিরোপা জিতেছিল।

মোটর স্পোর্টস ডিভিশনের দক্ষতাকে ব্যবহার করে কোম্পানিটি বাজারে আনে এম-৩ মডেলের গাড়ি যা বর্তমান সময়ে কোম্পানিটির আইকনিক গাড়ি গুলির মধ্যে অন্যতম। এরপর বিএমডাব্লিউর রেদ-১ নামে ২ সিটের রোস্টার গাড়ি বাজারে আনে, মূলত তাদের তৈরি মেজর কোন প্রজেক্ট যা ম্যাস প্রডাকশনে যায়। স্পোর্টই, রুফলেস স্টাইলিশ দুই

দরজার এই গাড়ি তৈরির কাজ চলে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত চলে এবং মোট ৮ হাজারটি পণ্য তৈরি করা হয়। ব্যবসাসফল এই গাড়ির জনপ্রিয়তা দেখে বাজারের অন্যান্য ব্যান্ড এই ধরণের গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে জেড-৩ ও ২০০০ সালে জেদ-৮ মডেল গুলো বাজারে আনা হলেও বর্তমানে এই গাড়ি গুলো আর প্রস্তুত করা হয় না। তবে ২০০২ সালে প্রস্তুত হওয়া বিএমডাব্লিউ জি-৪ গাড়িটি একমাত্র রোস্টা যা এখনও বাজারজাত করা হয়।

১৯৯৪ সালে বিএমডাব্লিউ প্রথমবারের মত জার্মানির বাইতে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলাইনাতে তাদের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্বজুড়ে এসইউভি ধরণের গাড়ি গুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের এক্স -৫ স্পোর্টস গাড়ি বাজারে আনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি লাক্সারিয়াস মার্কেট তৈরি করতে সক্ষম হয়। বিএমডাব্লিউর এই সেগমেন্টটি ব্যবসা সফল করে তোলার পেছনে রোভার গ্রুপকে নিজেদের করে নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

একই সময় জেমস বন্ডের মত মুভিতে বিএমডাব্লিউ’র গাড়ি ব্যবহার করায় জনসাধারণের মাঝে তা ব্যপক সাড়া ফেলে। এছাড়া দ্যা ট্রান্সপোর্টার, ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস এবং মিশন ইম্পসিবল এর মত মুভিতে কোম্পানিটির গাড়ি ব্যবহার করা হয়।

 রোলস রয়েসকে কিনে নিতে বিএমডাব্লিউ এবংজার্মান কোম্পানি ফোক্সওয়াগেনের মধ্যে বেশ প্রতিযগিতা হয়। ১৯৯৮ সালে  রোলস রয়েস রোজ প্রাক্তন মালিক ভিকারস কোম্পানিটি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএমডাব্লিউ যেহেতু শুরু থেকেই   রোলস রয়েস এর জন্য ইঞ্জিন সরবার করা আসছিল তাই শুরুতেই এগিয়ে ছিল বিডে। কিন্তু একেবারে শেষ দিকে ফোক্সওয়াগেনের ৪৩০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিডের কাছে হার মানে বিএমডাব্লিউ।

ভিকারস মূলত  রোলস রয়েলস বিমানের ইঞ্জিন প্রডাকশন ইউনিট তাদের কাছে রেখে গাড়ি নির্মাণের সব কিছু বিক্রি করে দেয় ফোক্সওয়াগেনের কাছে। কিন্তু  রোলস রয়েস নিজের কাছে রাখে তাদের ব্রান্ড নেম এবং তাদের জনপ্রিয় লোগো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএমডাব্লিউ  রোলস রয়েস এর থেকে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়মে তাদের ব্যান্ড নেম ও লোগো কিনে নেয়। যার ফলে বিএমডাব্লিউ ফোক্সওয়াগেনের কাছে   রোলস রয়েস এর ইঞ্জিন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফোক্সওয়াগেনের পক্ষে সঠিক সময়ে ইঞ্জিন তৈরি করা সম্ভব হবে না বুঝতে পারে। তারা বিএমডাব্লিউ সাথে আলোচনার টেবিলে বসে।

বিএমডাব্লিউ বনাম রোলস রয়েস - দুটি আইকনিক লাক্সারি ব্র্যান্ডের তুলনামূলক ছবি।

বিএমডাব্লিউ ও রোলস রয়েস – বৈশিষ্ট্য ও অভিজাত্যের মাপকাঠিতে পার্থক্য। | ছবি: সংগৃহীত।

আলোচনায় সিদ্ধান্ত আসে বিএমডাব্লিউ ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত  ফোক্সওয়াগেনের কাছে  রোলস রয়েস গাড়ি তৈরির জন্য ইঞ্জিন সরবরাহ করবে এবং ফোক্সওয়াগেন লোগো এবং ব্রান্ড নেম ব্যবহার করতে পারবে। ২০০৩ সাল থেকে বিএমডাব্লিউ একাই  রোলস রয়েস গাড়ি তৈরি শুরু করে।  রোলস রয়েসের জন্য ঘোস্ট, ভ্যান্তাম এবং রেইথ মডেলের গাড়ি বাজারে আনে বিএমডাব্লিউ যা বিশ্ব জুড়ে ব্যপক সাড়া ফেলে। এছাড়া ব্রিটিশ এরোস্পেসের থেকে বিখ্যাত গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান রভার গ্রুপকে কিনে নেয় বিএমডাব্লিউ।

ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে গাড়ির মার্কেট ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরি করছে। এরই সাথে তাল মেলতে ২০১০-এ বিএমডাব্লিউ তাদের প্রথম হাইব্রিড গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে। এরপর ২০১৩ সালে কোম্পানিটি তাদের প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি BMW i3 তৈরি করে।

বিএমডাব্লিউ i3 মডেল - বৈদ্যুতিক গাড়ির সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ডিজাইনের ছবি।

বিএমডাব্লিউ i3 – পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সাথে আধুনিক ডিজাইনের সমন্বয়। | ছবি: সংগৃহীত।

বর্তমান বিশ্বজুড়ে গ্লোবাল মার্কেটে বিএমডাব্লিউ ৮ম অবস্থানে আছে। কোম্পানিটির ৩৩.৫ শতাংশ গাড়ি আমদানি করে চীন এছাড়া জার্মানি এবং আমেরিকা থেকে তারা ১০ শতাংশের অধিক গাড়ি বিক্রি করে থাকে।  বর্তমানে বিএমডাব্লিউ মোট ক্যাপিটাল ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

“তথ্যসূত্র”

ক্রেডিট কার্ডের যথাযথ ব্যবহার ও ঋণ এড়ানোর উপায়

Previous article

যেভাবে পতন হলো বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠান বাইজুসের

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *