Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আনিকা তায়্যিবা |
যদি বলা হয় বাংলাদেশী ৩০০ টাকা নিয়ে যদি আপনি ইরানে যান, নিঃসন্দেহেই আপনাকে সেখানে দেয়া হবে লাখপতির তকমা! আর ভিয়েনতনামে যদি বাংলাদেশী ৫০০০ টাকা নিয়ে ঘুরতে যান মিলিওনিয়ার বনে যাবেন সেদেশে! শুনে কিছুটা অবাক হচ্ছেন, তাইনা? তবে তা আদতে সত্যিই! সেসব দেশের প্রচলিত মুদ্রার মান এতটাই কম যে আমেরিকার মার্কিন ডলার তো বটেই- আমাদের দেশের সাপেক্ষেও তাদের দেশের মুদ্রার বিনিময় হার অনেক অনেক কম।
যখন আমরা বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রা নিয়ে ভাবি, সাধারণত উন্নত দেশের নানা মুদ্রা যেমনঃ মার্কিন ডলার, পাউন্ড স্টার্লিং বা সুইস ফ্র্যাঙ্ক -এর মতো মুদ্রাগুলোর নামই মাথায় আসে। কেননা, এই মুদ্রাগুলো তাদের দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উচ্চমূল্যের জন্য সুপরিচিত। তবে মুদ্রার এপিঠও কিন্তু রয়েছে। এশিয়া, আরব বিশ্ব এবং আফ্রিকার স্বল্পোন্নত বা অনুন্নত কিছু দেশের প্রচলিত মুদ্রা বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে ব্যাপক অবমূল্যায়নের শিকার হয়। ফলে, অন্যান্য দেশের প্রেক্ষিতে এসব দেশের মুদ্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
আজ আমরা জানব বিশ্বের সব চাইতে দুর্বলতম ১০ টি মুদ্রা সম্পর্কে যেগুলো বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে।
১. লেবানিজ পাউন্ড
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল মুদ্রা হলো লেবানিজ পাউন্ড। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে লেবানিজ পাউন্ডের মান কমে তলানিতে এসেছে। দেশটি বর্তমানে সরকারি ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং ধসে পড়া ব্যাংকিং খাতের মুখোমুখি। ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ৭৪৯ লেবানিজ পাউন্ড।
২. ইরানি রিয়াল
ইরানের প্রচলিত মুদ্রা রিয়াল। বর্তমানে ইরানি রিয়াল বিশ্বের অন্যতম দুর্বল মুদ্রা হিসেবে পরিচিত। ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ৩৫১ ইরানি রিয়াল। এই মুদ্রার পতনের পেছনে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইরান ও ইরাকের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ, পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, জরিমানা এবং অভ্যন্তরীন অস্থিতিশীলতার মতো বিষয়গুলো দায়ী। এসব সংকট দেশটির অর্থনীতিকে প্রবল চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে, যার ফলে মুদ্রার মূল্য কমতে কমতে তলানিতে নেমে এসেছে।
৩. ভিয়েতনামি ডং
এরপর আমরা যেই মুদ্রা সম্পর্কে জানব তা হলো ভিয়েতনামের প্রচলিত মুদ্রা, ডং। এই মুদ্রা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে কম মূল্যের মুদ্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভিয়েতনাম দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে। বাজার ও শ্রমভিত্তিক অর্থনীতির দিকে ধীরে ধীরে দেশটি এগোলেও এই দেশের মুদ্রা এখনও চাপের মুখে রয়েছে। ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ২১১ ভিয়েতনামি ডং । এই অর্থনৈতিক সংস্কারের ধীরগতিই ডং-এর এই নিম্নমূল্য ধরে রাখার অন্যতম কারণ।
৪. সিয়েরা লিওনীয় লিয়ন
সিয়েরা লিওনের ব্যবহৃত মুদ্রা হলো লিয়ন। দেশটির দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য, দুর্নীতি, এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মুদ্রার নিম্ন মূল্যমানের কারণ। সিয়েরা লিওন দীর্ঘ এক গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়েও গেছে, যা দেশটির অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। বর্তমানে ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ১৮৯ লিয়ন। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থার কারণে এই দেশের মুদ্রার মূল্য কমে গেছে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
৫. লাওশিয়ান কিপ
লাওসের প্রচলিত মুদ্রা হলো লাওশিয়ান কিপ। এটি চালু হয় ১৯৫২ সালে। চালু হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে নিম্নমূল্যের মুদ্রা হিসেবে টিকে আছে লাওশিয়ান কিপ। তবে আশার কথা, গত কয়েক বছরে এই মুদ্রার মূল্য কিছুটা বেড়েছে। বর্তমানে ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ১৮৩ লাওশিয়ান কিপ। লাওস সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নানা উদ্যোগ নিলেও দেশটির আর্থিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং বৈদেশিক সহায়তার উপর নির্ভরশীলতা কিপের মূল্যমান বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
৬. ইন্দোনেশীয় রুপিয়া
গত এক দশকে ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়ার মান উল্লেখযোগ্য কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, নিত্যপণ্যের দামে ওঠানামা, এবং রফতানি পণ্যের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মুদ্রাটির বিনিময় হার কমার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ১৩০ ইন্দোনেশীয় রুপিয়া। ইন্দোনেশিয়ার ঋণপত্রের একটি বড় অংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকায় অর্থনীতিতে মূলধনের প্রবাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে মুদ্রার মান কমতে থাকে, যা দেশটির ক্ষেত্রে হয়েছে।
৭. উজবেকিস্তানি সোম
উজবেকিস্তানে প্রচলিত মুদ্রা সোম মধ্য এশিয়ার অন্যতম দুর্বল মুদ্রা হিসেবে পরিচিত। কোভিড-১৯ এর পর থেকে দেশটির মুদ্রার মান ক্রমান্বয়ে কমতে তথাকে। করোনা মহামারি দেশটির শিল্পোৎপাদনে বেশ বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা এর অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। বর্তমানে ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ১০৭ উজবেকিস্তানি সোম । যদিও দেশের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে পুনরায় গতি আসতে শুরু করেছে, তবে এখনও উজবেকিস্তানের মুদ্রা সোমের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
৮. গিনি ফ্র্যাঙ্ক
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনির সরকারি মুদ্রা হলো ফ্র্যাঙ্ক। দেশটির দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ধারাবাহিকভাবে ফ্রাঙ্ক এর মূল্য হারাচ্ছে। গিনি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক দেশ হওয়া সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এই দেশটির মুদ্রা বছরের পর বছর দুর্বল অবস্থায় পতিত হচ্ছে। বর্তমানে ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ৭২ গিনি ফ্র্যাঙ্ক।
৯. প্যারাগুয়ান গুয়ারানি
প্যারাগুয়ের মুদ্রা গুয়ারানি দেশের অর্থনৈতিক সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি, এবং বেকারত্বের কারণে ব্যাপক অবমূল্যায়নের শিকার। বর্তমানে ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ৬৬ গুয়ারানি। অতীতের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এখনও দেশটির অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, ফলে প্যারাগুয়ের মুদ্রার মান এখনো স্থিতিশীল হতে পারেনি।
১০. কম্বোডিয়ান রিয়েল
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে কম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের জনগণের কম্বোডিয়ান রিয়েলের প্রতি আস্থা কমে গিয়েছিল। যার ফলে তাদের মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কম্বোডিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিয়েলের প্রচলন ও ব্যবহার বাড়াতে চেষ্টা করেছে, তবুও দেশের আর্থিক লেনদেনের বড় অংশ এখনও মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে ১ বাংলাদেশী টাকা সমান প্রায় ৩৩ কম্বোডিয়ান রিয়েল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, এবং পণ্য রফতানির উপর নির্ভরশীলতা সেসব দেশের মুদ্রার বিনিময় হার কমার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। কিছু দেশ যেমন লাওস এবং উগান্ডার মুদ্রার মূল্য কিছুটা উন্নতি করলেও ইরান ও সিয়েরা লিওন এখনো সংকটে। তবে যেসব দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সমূহ সম্ভাবনা আছে।
Comments