আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এন্ড মেশিন লার্নিং

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া

আধুনিক জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলতে মানব বুদ্ধিমত্তার বিকল্প হিসাবে কাজ করতে সক্ষম একটি মানবসৃষ্ট এজেন্টকে বোঝায়। এটি আধুনিক প্রযুক্তির বিপ্লবী আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি। প্রযুক্তি এবং পরিষেবার বিশ্বায়নের সঙ্গে  উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছে।

ধরুন আপনার ঘুম ভাঙলো সকাল ৬টায় এবং আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার এই কাজটি করলো একটি যন্ত্র! সকাল সকাল আপনার চা-নাস্তা বা পত্রিকাটিও আপনার টেবিলে হাজির। সকালের নাস্তা তৈরী করতে কোনো ঝামেলাই আপনাকে পোহাতে হলোনা। সঠিক সময়ে এবং নির্ভুলভাবে প্রস্তুত করে দিলো আপনারই কমান্ড দেওয়া কোনো যন্ত্র। ভেবে দেখুনতো আপনার এই বিষয়গুলো দৈনন্দিন কাজে কতটা উপকারি হবে!

এই পুরো বিষয়টিই কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবটের উপস্থিতিতেই সম্ভব। আপনি যা করতে চান, সারাদিনে তা কোনরুপ বিরতি ছাড়া এবং নির্ভুলভাবে করে দিতে পারবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্রটি। । তবে আপনাকে শুধুমাত্র কমান্ডটা ঠিকমত দিতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ- বিশ্বের বড় অনলাইন বিকি-কিনির সাইট আমাজানের বড় শোরুমগুলোতে যখন আপনি কিছু কিনতে যাবেন, আপনাকে কোনোরূপ বিক্রেতার সাথে কথা বলতে হবেনা। কারণ, সেই দোকানের কর্মচারী হতে শুরু করে সবাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট। এইরকম শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। যার ফলে গতানুগতিক দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীরা চাকরি হারাচ্ছে এবং পোগ্রামারদের চাহিদা তৈরী হচ্ছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অবিরাম প্রচেষ্টা এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অবিরাম প্রচেষ্টা। | ছবি সংগৃহীত।

সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অবিরাম প্রচেষ্টার কারণে বাংলাদেশকে ডিজিটালভাবে উন্নত উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সরকারের উদ্যোগে কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবহন এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক পরিষেবা ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন খাতে প্রযুক্তির এই দ্রুত অনুপ্রবেশ গবেষকদেরকে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে একটি সমৃদ্ধশালী এবং অসাধারণ ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি চিকিৎসা সেবা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা এবং পরিবহন মাধ্যমের ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান করে মানুষের সামাজিক জীবনে অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিবর্তন

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কর্মক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তির দ্রুত বিশ্বায়নের সাথে দেশকে ডিজিটাল করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গ্রহণ ও প্রবর্তন করেছে। বাংলাদেশ সরকার সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই উন্নত প্রযুক্তিগত ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ কর্মক্ষেত্রের সাথে একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল চালিত রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকারের দ্বারা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) স্থাপন, তথ্য ও সেবা প্রদানের একক স্টপ অ্যাক্সেস পয়েন্ট, সরকারি সেবা প্রদানকে বিকেন্দ্রীকরণ এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য গৃহীত হয়েছে।

বর্তমানে, বাংলাদেশে ৫৮৩৮টিরও বেশি ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে যা ৪২২ মিলিয়ন নাগরিককে সেবা দিচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন পোর্টাল চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশকে এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আউটসোর্সিংয়ের জন্য একটি উদীয়মান দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয় কারণ মোবাইল ফোনের ব্যবহার, ইন্টারনেট সংযোগের সহজলভ্যতা, আইটি রপ্তানি আয় এবং বিভিন্ন সরকারি কার্যকলাপে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার এবং সরকারি সংস্থায় ডিজিটাল অ্যাক্সেসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে।

বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল উন্নয়নের নতুন দিগন্ত।

বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিবর্তন এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন দিগন্তের সূচনা। | ছবি সংগৃহীত।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ সফলভাবে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ যাত্রার যুগে প্রবেশ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সালের মধ্যে দেশজুড়ে পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তি চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই অভিলাষী উদ্যোগ ডিজিটাল সংযোগে বিপ্লব ঘটাবে, দ্রুত ইন্টারনেট গতি সক্ষম করবে এবং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত অগ্রগতির দ্বার উন্মোচন করবে।

বাংলাদেশ এর বিভিন্ন সেক্টরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা

কৃষি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মূল চালিকা শক্তি। জনসংখ্যার ৩০% এরও বেশি মানুষ্যের জীবিকা নির্বাহের মূল ভিত্তি এটি। বাংলাদেশের কৃষি খাতে এআই বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন: ফসলের রোগ নির্ণয়, মাটি পরীক্ষা, সেচ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। সরকার আরও ২০০ টিরও বেশি তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছে যেখানে অভিজ্ঞ কৃষকরা অন্যদের আরও ভালো কৃষি পদ্ধতির বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে।

কৃষি.গভ.বিডি ওয়েবসাইট এবং ৩৩৩১ নম্বরের হেল্পলাইনগুলো অতিরিক্ত সহায়তা দেয়। ২০১৮ সালের অর্থনৈতিক জরিপ অনুযায়ী, কৃষি বাংলাদেশের জিডিপিতে ১৪% এরও বেশি অবদান রাখে।

কৃষি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, যেখানে প্রযুক্তি কৃষির উন্নতি এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।

কৃষি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে প্রযুক্তির অবদান ও উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ। | ছবি সংগৃহীত।

পরিবহন খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

বাংলাদেশের পরিবহন খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব ঘটাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে রাস্তার অবকাঠামোতে দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছে, যার মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রো রেল ব্যবস্থার নির্মাণ অন্যতম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা -চালিত ব্যবস্থা ট্রাফিক প্রবাহকে অপ্টিমাইজ করছে, যানজট কমিয়ে আনছে এবং সামগ্রিক পরিবহন দক্ষতা উন্নত করছে। তবে, ডেটা গোপনীয়তা ও সাইবার নিরাপত্তার মতো চ্যালেঞ্জগুলো সম্বোধন করা প্রয়োজন এই খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা -এর সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য।

শিক্ষা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিপ্লব আনতে প্রস্তুত। এআই ব্যবহার করে আমরা শিক্ষার অভিজ্ঞতা বাড়াতে, নির্দেশনা ব্যক্তিগতকৃত করতে এবং শিক্ষার্থীর ফলাফল উন্নত করতে পারি। এআই-চালিত সরঞ্জাম শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স ডাটা বিশ্লেষণ করে শক্তি, দুর্বলতা এবং শিক্ষার ফাঁক চিহ্নিত করতে পারে। এআই প্রশাসনিক কাজ স্বয়ংক্রিয় করতে পারে, শিক্ষকদের ছাত্রদের সঙ্গে আরও অর্থপূর্ণ মিথস্ক্রিয়তায় মনোনিবেশ করার সুযোগ করে দেয়।

আর্থিক খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত পরিবর্তন আনছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহক সেবা উন্নত করতে, প্রতারণা শনাক্ত করতে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে। বিপুল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে, এআই -চালিত সিস্টেম প্যাটার্ন এবং অস্বাভাবিকতা চিহ্নিত করতে পারে, যা প্রতারণামূলক কার্যকলাপের প্রাথমিক সনাক্তকরণের সুবিধা দেয়।

স্বাস্থ্যসেবা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)

স্বাস্থ্যসেবা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার, যা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করছে।

স্বাস্থ্যসেবা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার এবং উন্নত চিকিৎসা সেবা। | ছবি সংগৃহীত।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) স্বাস্থ্যসেবা খাতে রোগ নির্ণয়, ওষুধ আবিষ্কার এবং অস্ত্রোপচার পদ্ধতিতে সহায়তা করেছে। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত এআই এর সম্ভাবনার পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও কিছু প্রাথমিক অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে, তবুও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এখনও অনুপস্থিত। ফলে অনেকের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ফলাফল অপর্যাপ্ত হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে সীমিত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো, দক্ষ পেশাদারদের অভাব ইত্যাদি চ্যালেঞ্জগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার এআই এর রূপান্তরকারী ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে এবং সমস্ত বাংলাদেশির জন্য স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে পারে।

কর্মক্ষেত্র থেকে দৈনন্দিন জীবন পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এআই কেবল জীবনকে সহজ করে তোলেইনি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৃদ্ধিকে প্রভাবিত ও ত্বরান্বিতও করেছে। এটি কেবল একটি দেশের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং সামাজিক উন্নয়নকেই প্রভাবিত করে না, বরং তথ্য ও তথ্য বিনিময়ের ব্যক্তিগত পছন্দকেও প্রভাবিত করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আন্তর্জাতিক বাজারে একটি দেশের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক অবস্থার পূর্বাভাস দেয়। এটি একটি জাতিকে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে অবস্থান নিশ্চিত করে।

“তথ্যসূত্র”

পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রনিক যান: সবুজ পৃথিবীর সূচনা

Previous article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *