Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির |
খুচরা বিপণনের অসাধারণ যাত্রা বিগবাজার
এইতো কয়েক বছর আগে ভারতের খুচরা বাজারে বিগবাজারের আবির্ভাব ও প্রভাব ছিল অনেক বিশাল। এর প্রতিষ্ঠাতা কিশোর বিয়ানি, যিনি “ফিউচার গ্রুপ” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাজার নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখে ছিলেন। ২০০১ সালে বিগবাজারের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু এর আগে কিশোর সাহেব কাপড় ও কটনের ব্যবসা করতেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুঝতে পারেন যে, ভারতীয় বাজারে বড় ধরণের শপিং অভিজ্ঞতা আনার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে তার লক্ষ্য ছিল বিশেষ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য কাজ করা।
কিশোর বিয়ানির ফিউচার গ্রুপের বিস্তার
কিশোর বিয়ানি একজন অত্যন্ত উদ্যমী ও ভবিষ্যৎমুখী উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি ফিউচার গ্রুপের ব্যানারে একাধিক খুচরা ব্যবসা গড়ে তোলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্যান্টালুনস, বিগ বাজার ,সেন্ট্রাল । তিনি ক্রেতাদের মনের কথা পড়তে পারতেন এবং জানতেন কীভাবে মধ্যবিত্তের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হয়। ফিউচার গ্রুপের এই বিপণন কৌশল ছিল একেবারেই অন্য রকমের। কিশোর বিয়ানি ব্যবসার মূলত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যে, বড় পরিসরে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পণ্য বিক্রির ধারণার উপর। বড় বড় সেল ইভেন্ট (যেমন, ‘বিগ ডে সেল’, ‘সুপার সেভার উইকেন্ড’) আয়োজন করে ক্রেতাদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
বিগবাজারের উত্থান ও মধ্যবিত্তের জন্য এক আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা
বিগবাজার ভারতীয়দের মাঝে একটা আলাদা ধরনের বাজারের ধারণা এনে দেয়। এটি সাধারণ শপিং মলের ধারণাকে একেবারে মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসে। বড় আউটলেটগুলো শহরের ব্যস্ত এলাকায় স্থাপন করা হয়, যেখানে ক্রেতারা শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিসই কিনতেন না, বরং পারিবারিক সময় কাটানোর একটি স্থান হিসেবে বিবেচনা করতেন। বিগবাজারের আউটলেটগুলোতে বৈচিত্র্যময় পণ্য যেমন মুদিখানা, পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি পাওয়া যেত। এটি সাধারণ বাজারের চেয়ে অনেক বড় ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে ভারতীয় বাজারের সাথে সংযোগ রেখে তৈরি করেছিলেন কিশোর। এর মূল লক্ষ্য ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করা এবং তাদের জন্য একটি উপভোগ্য শপিং অভিজ্ঞতা প্রদান করা। এই কারণেই শপিং মলের বাইরে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ভিড় একটা সাধারণ দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং ফিউচার গ্রুপের প্রসার
ফিউচার গ্রুপের আওতায় একাধিক প্রতিষ্ঠান চালু হয়, যা ক্রেতাদের বিভিন্ন পণ্য ও সেবা প্রদান করে। যেমনঃ
‘প্যান্টালুনস’ একটি পোশাক ব্র্যান্ড, যা ভারতে বড় শপিং মলে প্রবেশের প্রথম দিকের প্রতিষ্ঠান। ‘সেন্ট্রাল’ একটি উচ্চমানের শপিং মল, যেখানে বিভিন্ন বিলাসী ব্র্যান্ডের পোশাক থেকে শুরু করে জুয়েলারি ও পারফিউম পাওয়া যায়। ‘হোম টাউন’ গৃহস্থালি পণ্য ও আসবাবপত্রের জন্য বিশেষায়িত আউটলেট। ‘ফুড বাজার’ বিগবাজারের অধীনে একটি খাদ্য সামগ্রীর আউটলেট, যেখানে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যেত।
২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দাও বিগবাজারের পতনের শুরু
২০০৮ সালে যখন বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়, তখন এর প্রভাব ভারতের অর্থনীতিতেও পড়তে থাকে। ফিউচার গ্রুপের উপরেও এর প্রভাব অনেক মারাত্মকভাবে পড়ে। মূলত, ফিউচার গ্রুপের ঋণ গ্রহণ তখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এটি ব্যবসার উপর এক বিশাল চাপ সৃষ্টি করে। প্রায় ১২০০ শত কোটি টাকা ঋণে পরে যায় বিগ বাজার। অন্য দিকে কিশোর সাহেবের একের পর এক পদক্ষেপ ভুল প্রমাণিত হচ্ছিল। মূলত ক্রেতাদের মধ্যে টাকা না থাকায় তাদের খরচের ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তাই বিগ বাজারের বিক্রির পরিমাণও কমতে থাকে। এছাড়াও, ২০১০ সালের পরে অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মের প্রবেশ বিগবাজারের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তোলে। অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের মত প্ল্যাটফর্মগুলো গ্রাহকদের কাছে সহজলভ্য ও দ্রুতগতির সেবা দিচ্ছিল। ফলে বিগবাজারের গ্রাহক সংখ্যা কমতে থাকে। কারণ অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের মত বড় অনলাইন মার্কেটকে সেই সময় টপকে যাওয়া বিগ ব্যাজারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে বিগবাজার এমন সব ফিচার তাদের ক্রেতাদের দিতে চাচ্ছিলেন যা মূলত ভবিষ্যৎ নির্ভর ছিল যা মানুষকে খুব একটা আগ্রহী করে তুলতে পারেনি।
বিগ ব্যাজারের শেষ পরিণতি
বিগবাজারের উত্থান ও পতনের এই গল্পটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের গল্প নয়, বরং ব্যবসায়িক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে কিভাবে মানিয়ে নিতে হয় তার শিক্ষা দেয়। আধুনিক প্রযুক্তি, ক্রেতাদের পরিবর্তিত চাহিদা এবং প্রতিযোগিতার মোকাবিলা না করতে পারলে কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটে তা বিগবাজারের পতন থেকে বোঝা যায়। ভারতীয় খুচরা বাজারে বিগবাজারের এই যাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে, প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন যত বড়ই হোক না কেন, সময়ের সাথে নিজেকে পরিবর্তিত করতে হবে, নতুবা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া অবধারিত।
Comments