Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির |
স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবন ও ব্র্যাকের যাত্রা একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প। তার ব্রাকের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, ও শিক্ষার প্রসার সহ বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমে অভূতপূর্ণ উন্নতি সাধন সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুর্ন:গঠনের লক্ষ্যে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ দিয়ে ব্রাক যাত্রা শুরু করেছিল। এখন এই সংস্থাটি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের সব থেকে বড় এনজিও ব্র্যাক।
কে এই স্যার ফজলে হাসান আবেদ?
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন একজন দূরদর্শী এবং মানবতাবাদী মানুষ। যিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নের জন্য তার পুরো জীবন কাজ করে গেছেন। ১৯৩৬ সালে হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন আবেদ স্যার। তার শিক্ষাজীবন শেষ করে ব্রিটেনে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বদেশের মানুষের কষ্ট দেখে তৎক্ষণাৎ দেশে ফিরে আসেন। দেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান তিনি। এজন্য তিনি তার লন্ডনের সম্পত্তি বিক্রি করে দেশে ফিরে আসেন এবং ত্রাণের জন্য সংগ্রহকৃত অর্থ দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেন। তবে স্যার আবেদের চিন্তা ভাবনা ছিল অনেক দূরদর্শী সম্পন্ন। মানুষকে সেবা দেবার চিন্তা ভাবনা থেকেই আজকের ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। শুরুতে ব্র্যাক শুধু কেবল ত্রাণ বা পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করতো। তবে স্যার আবেদ চেয়েছিলেন ব্র্যাক দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এমন একটি মডেল তৈরি করুক যা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করবে। স্যার আবেদের অসামান্য নেতৃত্ব ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারসহ আরও বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন, যা তাকে বিশ্বব্যাপী মানব উন্নয়নের অনন্য উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
ব্র্যাকের সূচনা ও প্রথম দিকের পদক্ষেপ
ফজলে আবেদ বাংলাদেশে দারিদ্র্য নিরসনে সমাজ উন্নয়নের একটি নতুন মডেল প্রতিষ্ঠা করেন। ব্র্যাকের প্রথম উদ্যোগ গুলোর মধ্যে ছিল কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং স্বল্প ব্যয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। ১৯৭৬ সালে তিনি নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আড়ং নামে একটি সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ চালু করেন। আড়ংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা হস্তশিল্পে প্রশিক্ষিত হয় এবং ঢাকার বাজারে তাদের তৈরি পণ্য বিক্রি করে নিজেদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলেন। ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের উন্নয়নশীল কাজ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যা আজ প্রায় ৬০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে আছে। ব্র্যাকের শিক্ষামূলক কার্যক্রম থেকে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, মানবাধিকার, এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্র্যাক বিশেষভাবে সফল। উদাহরণস্বরূপ, ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি দরিদ্র মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে এবং এর মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কার্যক্রমের প্রসার
প্রথম থেকেই আবেদ স্যার বুঝতে পারেন যে শুধু ত্রাণ সহায়তা দিয়ে দেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। এজন্য তিনি স্বল্প ব্যয়ে স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেন। ব্র্যাকের ‘আশার আলো’ নামক উদ্যোগের মাধ্যমে দরিদ্র গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। এর মাধ্যমে তারা হস্তশিল্প, পোল্ট্রি, এবং কৃষিকাজে দক্ষ হয়ে ওঠে, যা তাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলে। ১৯৭৬ সালে, আবেদ স্যার নারী শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে একটি অগ্রগামী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ব্র্যাক কাজ শুরু করে। বর্তমানে, ব্র্যাক প্রায় ৬০টি দেশে বিভিন্ন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করে আসছে।
আড়ং এবং ব্র্যাকের অন্যান্য উদ্যোগ
ব্র্যাকের অধীনে আড়ং একটি সফল সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৮ সালে প্রথম বিক্রয়কেন্দ্র খোলার পর থেকে আড়ংয়ের বাৎসরিক বিক্রয় প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় এবং এটি বাংলাদেশের একটি সফল ব্যবসায়িক উদ্যোগে পরিণত হয়। মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, যা আড়ংয়ের মূল উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে দেশজুড়ে আড়ংয়ের ১৪টি কেন্দ্রে আছে। আড়ংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৬৫,০০০ মানুষ কর্ম সংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন, যাদের একটি বড় অংশ নারী। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রায় ৪৫ শতাংশই নারী, যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। যদিও বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ সমালোচনা সম্মুখীন হচ্ছে আড়ং। এছাড়া ২০০১ সালে ব্রাকের প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ও বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্র্যাকের প্রভাব
স্যার ফজলে হাসান আবেদের মডেলটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র দেশে মানব উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। তার এই কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১৯ সালে তার মৃত্যুর পরও ব্র্যাক তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের এই কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে দারিদ্র্যতা শুধু অর্থের অভাব নয়, বরং সুযোগ- সুবিধা ও শিক্ষার অভাবও বটে। কিন্তু সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।
Comments