Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়শা মারিয়া |
রয়্যাল এনফিল্ড বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড, যা এখনও মোটরসাইকেল তৈরি করছে। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হওয়া রয়্যাল এনফিল্ড এর যাত্রা এখনও অব্যাহত রয়েছে, সৃষ্টি করছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে নতুন উত্তেজনা। এটি শুধু মোটরসাইকেল নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি ঐতিহ্য। জনপ্রিয় এই মোটরসাইকেল ব্রান্ডের বয়স ১২০ বছরেরও বেশি।
অনেকেই মনে করেন বিখ্যাত মোটরসাইকেল রয়েল এনফিল্ড হলো ভারতের ব্রান্ড। এমনকি ভারতীয়রা একে তাঁদের নিজস্ব পণ্য মনে করেন। ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে ভারতীয় যারা, রয়্যাল এনফিল্ডের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না তারা এটিকে নিজস্ব ব্রান্ড হিসেবেই মনে করেন। রয়েল এনফিল্ডের মূল শিকড় হচ্ছে যুক্তরাজ্যে।
রয়্যাল এনফিল্ড ক্লাসিক মোটরসাইকেল ছাড়াও, অ্যাডভেঞ্চার এবং অফ-রোড ধরনের মোটরসাইকেল তৈরি করে। ফোর্বসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালে রয়্যাল এনফিল্ড বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড হার্লে-ডেভিডসনের চেয়ে বেশি সংখ্যক কাল্ট ক্লাসিক মোটরসাইকেল বিক্রি করেছে। সেই বছরে রয়্যাল এনফিল্ড প্রায় ৩০০,০০০ ইউনিট মোটরসাইকেল বিক্রি করেছে, যা হার্লে ডেভিডসনের বিক্রিত প্রায় ২৬৮,০০০ মোটরসাইকেলের তুলনায় বেশি।
রয়্যাল এনফিল্ড এর ১২০ বছরের যাত্রা
১৮৯৮ প্রথম মোটরচালিত যান তৈরি করলেও নতুন শতাব্দীতে এক নতুন চমক নিয়ে ১৯০১ সালে যাত্রা শুরু হয় রয়েল এনফিল্ডের মোটরসাইকেলের । রয়্যাল এনফিল্ডের ইতিহাসের শুরুতেই জর্জ টাউনসেন্ড নামটি উঠে আসে। ১৮ বছর বয়সে তিনি “টাউনসেন্ড অ্যান্ড ইকোসাইস” নামে কোম্পানি তৈরি করে সাইকেল বিক্রি শুরু করে। কিন্তু ১৮৯১ সালে কোম্পানিটির অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ধস নামে। ফলে টাউনসেন্ড ব্যাংকার বার্মিংহাম পেরি অ্যান্ড কো লিমিটেডের সেলস ম্যানেজার অ্যালবার্ট এডি এবং উদ্যোক্তা বব ওয়াকার স্মিথকে সাইকেল ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। ১৮৯৬ সালেই বব ওয়াকার স্মিথ কোম্পানির প্রথম মোটরযান ডিজাইন করেন। এই যানবাহন যাকে কোয়াড্রিসাইকেল বলা হয়। একই বছরে কোম্পানিটি “দ্য এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি লিমিটেড” নামে নিবন্ধিত হয়। ১৯০০ সালে রয়্যাল এনফিল্ড ধীরে ধীরে মোটরস্পোর্টের দিকে এগিয়ে যায়। ১৯০১ সালে কোম্পানিটি বব ওয়াকার স্মিথ এবং জুলেস গোটিয়েট ডিজাইন করা প্রথম মোটরসাইকেলটি তৈরি করে।
রয়্যাল এনফিল্ডের যাত্রা শুরু হয় মাইনার্ভা ইঞ্জিন দিয়ে যা মোটরসাইকেলের স্টিয়ারিং হেডে লাগানো হতো। পিছের চাকা একটি দীর্ঘ চামড়ার বেল্ট দিয়ে চালিত হতো। ১৯০২ সালে এনফিল্ড গাড়ি তৈরি শুরু করে। এর ফলে ১৯০৬ সালে রেডডিচে একটি নতুন কোম্পানি “এনফিল্ড অটোকার কোম্পানি লিমিটেড” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি নতুন প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়।
নতুন সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে কোম্পানিটির বড় আর্থিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে আলবার্ট এডি তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা “বার্মিংহাম স্মল আর্মস কোম্পানি” কে বিক্রি করেন। বিক্রয়ের আগে, আলবার্ট এডি এবং বব ওয়াকার স্মিথকে বিএসএ-র পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। তারপর ১৯০৯ সালে এনফিল্ডের প্রথম ভি-টুইন মোটরসাইকেল লঞ্চ করা হয়।
১৯১৪ সালে, বব ও ফ্রাঙ্ক ওয়াকার স্মিথ যৌথভাবে এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানির পরিচালক হন। একই বছরে, রয়্যাল এনফিল্ড তাদের প্রথম ২-স্ট্রোক মোটরসাইকেলের উৎপাদন শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই কোম্পানি ব্রিটেন, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে মোটরসাইকেল সরবরাহ করে। যুদ্ধের পর, গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে কোম্পানি আরও ৮টি মডেল যোগ করে, যার মধ্যে রয়েছে প্রথম ৩৫০সিসি ও এইচভি ৪-স্ট্রোক মোটরসাইকেল এবং স্পোর্টস মডেল ৩৫১।
১৯৩২ সালে কোম্পানিটি রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট তৈরি করে যা সবচেয়ে আইকনিক এবং বহুমুখী মোটরসাইকেলগুলির মধ্যে একটি। ১৯৩৩ সালে বব ওয়াকার স্মিথের মৃত্যুর পর, ফ্রাঙ্ক কোম্পানির পরিচালনার নেতৃত্ব নেন। সেই বছরেই রয়্যাল এনফিল্ড গ্রাউন্ডব্রেকিং মডেল জেড সিগার চালু করে। যার ছিল ১৪৭সিসি টু-স্ট্রোক ফুলি এনক্লোজড ইঞ্জিন এবং যাত্রী নিরাপত্তার জন্য লেগ শিল্ড। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এনফিল্ড প্রথম “রয়্যাল এনফিল্ড এয়ারবোর্ন মোটরসাইকেল” তৈরি করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যারাশুটিস্টদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দুটি ৩৫০সিসি বুলেট ইতালিতে অনুষ্ঠিত “ইন্টারন্যাশনাল সিক্স ডেজ ট্রায়াল”-এ অংশ নেয় এবং উভয় রাইডার স্বর্ণপদক জিতে নেন।
ভারতে রয়্যাল এনফিল্ডের যাত্রাঃ
১৯৪৬-৫৪ সালে, বিশ্বযুদ্ধের পর রয়্যাল এনফিল্ড তাদের নতুন নতুন বাইকের ডিজাইন বাজারে আনতে শুরু করে। এই সময় তারা বিখ্যাত মডেল ‘বুলেট’ বাজারে আনে। বুলেট ৩৫০ সিসি এবং বুলেট ৫০০ সিসি খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলে। ‘
১৯৪৯ সালে ভারতের সরকার এমন এক মোটরসাইকেলের সন্ধানে ছিল, যেটি সীমান্তে টহল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে। সেসময়ই ৩৫০ সিসির বুলেট প্রথম ভারতের বাজারে আসে এবং এই বুলেট বাইকটি ভারতের সরকারের চিন্তার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।
ভারতীয় সেনাবাহিনী এটি ৮০০ ইউনিটের জন্য অর্ডার দেয়। মাদ্রাজ মোটরসের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানি রয়েল এনফিল্ড ১৯৫৫ সালে যৌথ উদ্যোগে চেন্নাইতে একটি সংযোজন কারখানা নির্মাণ করে। ভারতে প্রথম দিকে শুধু মোটরবাইক অ্যাসেম্বলিং করা হলেও ১৯৬২ সালের পর থেকে ভারতেই তৈরি হয় রয়েল এনফিল্ড। আর এভাবেই ভারতে বিকাশ লাভ করে রয়েল এনফিল্ড।
রয়্যাল এনফিল্ড বাইকের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। হার্লে ডেভিডসনকে হারিয়ে ২০১৪ সালে তারা গ্লোবাল সেলে শীর্ষে ওঠে। হার্লে ডেভিডসন সারা বিশ্বে যত বাইক বিক্রি করেছে তার থেকে বেশি বাইক শুধু ভারতেই বিক্রি করেছে রয়েল এনফিল্ড।
রয়্যাল এনফিল্ড এর বর্তমান বাজার অবস্থা
২০১৯ সালে রয়্যাল এনফিল্ড ভারতে ৮০৫,২৭৩টি মোটরসাইকেল বিক্রি করেছে। যা ভারতীয় দুই চাকার মোটরসাইকেল সেগমেন্টে ৩.৮% বাজার শেয়ার ধরে রেখেছে। তবে রাশলেনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫১-৫০০সিসি মোটরসাইকেল সেগমেন্টে কোম্পানির ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৩১,১৩৮৮টি বাইক বিক্রি হয়েছে, যা ৯৪.৬৫% বাজার শেয়ার দখল করেছে।
এদিকে ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় বাজারে আধিপত্য স্থাপনের পর, রয়্যাল এনফিল্ডের লক্ষ্য হল আমেরিকায় হার্লে ডেভিডসনের সাথে প্রতিযোগিতা করা। রয়্যাল এনফিল্ড বর্তমানে বিশ্বের ৫০টি দেশে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি মোটরসাইকেলের সিসি সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা করছে। এই প্রেক্ষাপটে, আইএফএডি অটোস বাংলাদেশে এনফিল্ডের বাইকের বিপণনের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
Comments