ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস

জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশ: নতুন স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক সংস্কার।

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আনিকা তায়্যিবা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলন দেশে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও পরিবর্তন এনেছে। এই বিপ্লবের ফলে পতন হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক ঘাটতি ও দুর্বলতাও উন্মোচিত হয়। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন দেশের সর্বোপরি সংস্কারের কাজ করছে—একটি কঠোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যেন বছরের পর বছর ধরে চলা দুর্নীতি ও শোষণের পর স্থিতিশীলতা এবং পুনর্গঠন নিশ্চিত করা যায়। চ্যালেঞ্জ অনেক, তবে পরিবর্তনের সুযোগও রয়েছে প্রচুর।

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরবর্তী বাংলাদেশের সর্বোপরি সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পরবর্তী বাংলাদেশের সর্বোপরি সংস্কার কার্যক্রম। | ছবি সংগৃহীত।

অর্থনৈতিক দুর্বলতার ক্ষেত্র

বিদায়ী আওয়ামী শাসন দেশে একটি বিপর্যস্ত অর্থনীতি রেখে গেছে, যেখানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, হ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণের বৃদ্ধি, এবং কম বিনিয়োগের মতো সমস্যাগুলো বিদ্যমান। সরকারি খাতের অদক্ষতা এবং ব্যক্তিগত খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব শিল্প ও সেবা খাতকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যার ফলে অর্থনৈতিক মন্দা বেড়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে বিধ্বংসী বন্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এই বন্যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রকল্পিত জিডিপির ০.২৬% সমপরিমাণ ক্ষতি করেছে, । অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা এবং মূল্য স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ

এই চ্যালেঞ্জগুলি উপলব্ধি করে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং ন্যায়সঙ্গত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য একাধিক সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ছয়টি মূল কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পাবলিক প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগ, এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার। বিশেষ করে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতকে লক্ষ্য করে এমন উদ্যোগগুলি গুরুত্বপূর্ণ, যা দীর্ঘদিন ধরে ঋণ খেলাপি ও দুর্বল নিয়ন্ত্রনের কারণে বর্তমানে সমস্যায় জর্জরিত।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কার

বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ব্যাংকিং খাতের অদক্ষতা দূর করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে ঋণ খেলাপি হ্রাস, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক পরিবেশ গড়ে তোলা। এছাড়া  ঋণের প্রক্রিয়া সহজ করার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য রাখছে।

সম্পদ সংগ্রহ ও অর্থনৈতিক কৌশল

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় “ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনীতি পুনঃকৌশলী এবং সম্পদ সংগ্রহ” শীর্ষক একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এই উদ্যোগটি কর সংগ্রহ উন্নত করা, বিদেশী ঋণের উপর নির্ভরতা কমানো, এবং টেকসই অর্থনৈতিক চর্চা প্রচারের মাধ্যমে আর্থিক ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলার জরুরিতা নির্দেশ করে।

তাত্ক্ষণিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

এই সংস্কার উদ্যোগ সত্ত্বেও, বেশ কয়েকটি তাত্ক্ষণিক চ্যালেঞ্জ এখনও বিদ্যমান:

পরবর্তী বাংলাদেশের তাত্ক্ষণিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা।

পরবর্তী বাংলাদেশের তাত্ক্ষণিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ। | ছবি সংগৃহীত।

১. উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি: বন্যার কারণে কৃষি উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, যা ক্রয়ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি এখনও উল্লেখযোগ্য ফলাফল আনতে পারেনি, কারণ বাজারের সিন্ডিকেটগুলি শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

২. আইন-শৃঙ্খলা: বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি শিল্প উৎপাদনশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে প্রভাবিত করেছে। সামরিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনে প্রদান করা হয়েছে, তবে একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।

৩. অবদমিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংক ৪%-এ নামিয়ে এনেছে, যা আগের বছরের ৫.৭% এর চেয়ে কম। এই পতন শিল্প ও সেবা খাতকে উদ্দীপিত করার জন্য অবিলম্বে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নির্দেশ করে।

টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য করণীয়

মানবসম্পদের ব্যবহার

বাংলাদেশের বিশাল মানবসম্পদ, বিশেষত নারী ও যুব সমাজ, এখনও যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি। মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। স্টেম /STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত) শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের উপর জোর দিয়ে একটি গতিশীল এবং স্থিতিস্থাপক শ্রমশক্তি তৈরি করা যাবে।

কৃষি খাতের আধুনিকায়ন

কৃষি খাত এর স্থিতিস্থাপকতা থাকা সত্ত্বেও এর উৎপাদনশীলতা এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য আধুনিকায়নের প্রয়োজন। উন্নত সেচ ব্যবস্থা, জলবায়ু সহনশীল শস্য, এবং ডিজিটাল কৃষি প্রযুক্তি প্রবর্তন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষকের আয় বাড়াতে পারে।

শিল্প খাতের বৈচিত্র্যকরণ

পোশাক শিল্পের মতো ঐতিহ্যগত খাতের উপর নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশকে তার শিল্প খাত বৈচিত্র্যময় করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তি, এবং ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো উদীয়মান ক্ষেত্রগুলি উচ্চমূল্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি রপ্তানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।

পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্প খাতের বৈচিত্র্যকরণে উদ্যোগ ও সম্ভাবনার চিত্র।

পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্প খাতের বৈচিত্র্যকরণ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উন্মোচন। | ছবি সংগৃহীত।

সামনের পথ

অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে স্থিতিশীল করতে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ এখনও দীর্ঘ এবং শ্রমসাধ্য। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে  শুরু হওয়া সংস্কারগুলোকে ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারগুলো দ্বারা এগিয়ে নিতে হবে যাতে এর ধারাবাহিকতা এবং সাফল্য নিশ্চিত হয়। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং জন অংশগ্রহণ গতি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সঠিক নীতিমালা এবং অবিচল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে রূপান্তরিত করতে পারে। জুলাই বিপ্লবে যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। পথটি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তবে একটি সমৃদ্ধশালী, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

“তথ্যসূত্র”

পাকিস্তান-বাংলাদেশ সরাসরি কার্গো শিপমেন্ট: দেশের বানিজ্য ও অর্থনীতিতে নতুন মোড়ের সূচনা।

Previous article

গ্র্যাটিটিউড জার্নালিং: জীবনে সাফল্য ও মানসিক শান্তির সেতুবন্ধন।

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *