Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির |
ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অন্তর্ভুক্ত মোট ২০টি সদস্য দেশ বর্তমানে একক এই ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করছে। ইউরোপের দেশ গুলোর জন্য এই মুদ্রা কেবল অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সহজতর করেনি, বরং ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সংহতি বাড়িয়েছে। তবে, এই একক মুদ্রার সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। চলুন আজকে জেনে নেওয়া যাক ইউরো মুদ্রার ভালো এবং খারাপ দিক সম্পর্কে।
ইউরোর সুবিধা
১. অর্থনৈতিক সংহতি ও বাণিজ্যের প্রসার
ইউরো মুদ্রা ব্যবহারের ফলে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য অনেক সহজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে যে জটিলতা ছিল, তা দূর হয়েছে। এখন ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলো সরাসরি একই মুদ্রায় লেনদেন করতে পারে। যেমন, জার্মানি থেকে ফ্রান্সে কোনো পণ্য রপ্তানি করতে গেলে মুদ্রা পরিবর্তনের দরকার হয় না। এটি ব্যবসার খরচ কমিয়েছে এবং বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ধরুন, আপনি বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পোশাক রপ্তানি করছেন। আগে প্রতিটি দেশে লেনদেন করার জন্য আলাদা আলাদা মুদ্রা রূপান্তর করতে হতো। এতে সময় এবং টাকা দুটোই বেশি লাগত।
২. পর্যটন খাতে সুবিধা
ধরুন, আপনি এক সপ্তাহের জন্য ইউরোপ ঘুরতে গেছেন। আগে যদি আপনি ফ্রান্স, জার্মানি, এবং স্পেন ঘুরতেন, তবে প্রতিটি দেশে ঢোকার আগে তাদের আলাদা মুদ্রা কিনতে হতো। এতে শুধু ঝামেলাই বাড়ত না, বরং আপনার ভ্রমণ ব্যয়ও বেশি হতো। কিন্তু এখন এই তিন দেশই ইউরো ব্যবহার করে। ফলে একবার ইউরো কিনলেই পুরো ভ্রমণ করতে পারবেন, আর নতুন মুদ্রা নিয়ে ভাবতে হবে না। এই বিষয়টি ইউরো ব্যবহারকারী প্রতিটি দেশের নাগরিকদের জন্য সমান সুবিধা প্রদান করে।
৩. মূল্য স্থিতিশীলতা
এখন চিন্তা করুন, যদি একটি দেশে মুদ্রার দাম বারবার ওঠানামা করে, তাহলে মানুষ ব্যবসা করতে বা ভ্রমণ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সেই দিক থেকেই ব্যতিক্রম ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলো কারণ তাদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক) আছে, যারা এই মুদ্রার দাম স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে। এর ফলে ইউরো অঞ্চলের মানুষ নিশ্চিন্তে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দৈনন্দিন কাজ করতে পারে।
ইউরোর চ্যালেঞ্জ
১. স্বাধীন আর্থিক নীতি প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা
ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলো তাদের আর্থিক নীতিতে পূর্ণ স্বাধীনতা হারায়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীস যখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, তখন তাদের নিজস্ব মুদ্রা থাকলে হয়তো অবমূল্যায়ন করে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ পেত। কিন্তু ইউরো ব্যবহারের ফলে তারা এটি করতে পারেনি। এরুপ আরেকটি উদাহরণ হলো, স্পেনের মন্দা (২০০৮-২০১২)- তখন স্পেনের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যদি তাদের নিজস্ব মুদ্রা থাকত, তবে অবমূল্যায়নের মাধ্যমে রপ্তানি বাড়িয়ে সংকট সামলানো যেত। কিন্তু ইউরো ব্যবহারের কারণে তারা তা করতে পারেনি, কারণ মুদ্রার মান নিয়ন্ত্রণ ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের হাতে।
২. ভিন্ন আর্থিক অবস্থার প্রভাব
ইউরোপের সব দেশের অর্থনীতি সমান শক্তিশালী নয়। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির মতো ধনী দেশগুলো ইউরো ব্যবহারের বড় সুবিধা পায় কারণ তাদের অর্থনীতি মজবুত। কিন্তু গ্রীস বা পর্তুগালের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো একক মুদ্রা ব্যবহারে সমস্যায় পড়ে। কারণ, তারা মুদ্রার মান কমিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ পায় না। যদি গ্রীসের নিজস্ব মুদ্রা থাকত, তারা মুদ্রার মান কমিয়ে পণ্য সস্তায় রপ্তানি করতে পারত। কিন্তু ইউরো ব্যবহারের কারণে তারা এই সুবিধা পায় না, কারণ ইউরোর মান নির্ধারণ হয় পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি অনুযায়ী।
৩. সংকট মোকাবিলার সীমাবদ্ধতা
ইউরো ব্যবহারের ফলে সদস্য দেশগুলো তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। একটি সাধারণ নীতি অনুসরণ করতে হয়, যা সংকট সমাধানে অনেক সময় দেরি করে। যেমন, গ্রীসের ঋণ সংকটের সময়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি অনুসারে সমাধানের জন্য দীর্ঘ সময় লেগেছিল, যা তাদের অর্থনীতির আরও ক্ষতি করে।
ইউরোর ভবিষ্যৎ
ইউরো বর্তমানে একটি শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে বিশ্বে তার অবস্থান ধরে রেখেছে। এই মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে ইউরোপীয়ান দের মধ্যে গর্বের শেষ নেই। এই নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন বলেন, “ইউরো শুধু একটি মুদ্রা নয়, এটি আমাদের ঐক্যের প্রতীক।”
দিন দিন বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে এর গুরুত্ব বাড়ছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে ইউরো ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে ইউরোর ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে এটি একদিন ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল ইউরো চালু করার পরিকল্পনা করছে, যা ইউরোর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করবে। তবে, কিছু চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ইউরো ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ এবং ইউরোর সম্পর্ক
বাংলাদেশের মতো রপ্তানি নির্ভর দেশের জন্য ইউরোপের বাজার ধরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম বৃহত্তম বাজার, এবং ইউরো একটি একক মুদ্রা যা ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা একই মুদ্রায় লেনদেন করতে পারেন, যা সময় এবং খরচ দুটোই বাঁচায়। এতে করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও সহজ এবং লাভজনক হয়।
বর্তমানে ২০টি ইইউ সদস্য দেশ ইউরো ব্যবহার করছে, তবে ডেনমার্ক এবং সুইডেনের মতো কিছু দেশ তাদের নিজস্ব মুদ্রা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে, এই দেশগুলোও আন্তর্জাতিক লেনদেনে ইউরো ব্যবহার করে। ইউরো ইউরোপের অর্থনৈতিক সংহতি এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যদিও এর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও ইউরো দীর্ঘমেয়াদে একটি সফল মুদ্রা হিসেবে নিজের অবস্থান বজায় রাখতে পারবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইউরো অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে আশা করা যায়।
Comments