Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির |
ডিজিটাল যুগে ডেটা প্রাইভেসি শুধু একটি ধারণা নয়; এটি আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায়ের টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্রাহকের আস্থা অর্জন থেকে শুরু করে আইনি ঝুঁকি মোকাবিলা পর্যন্ত, ডেটা প্রাইভেসি এখন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণার তথ্যমতে, ৭৮ শতাংশ গ্রাহক সেসব কোম্পানির ওপর আস্থা রাখেন যাদের স্পষ্ট পলিসি এবং ডেটা সুরক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। ডেটা প্রাইভেসি কিভাবে নিশ্চিত করা যায় এবং এটি কেনো গুরুত্বপূর্ণ চলুন জেনে নেয়া যাক।
গ্রাহক আস্থা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন লাখ লাখ গ্রাহকের ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্য সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হলে, গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সুনামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৮ সালের ফেসবুক ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি এই সমস্যার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। গ্রাহকের তথ্যের অপব্যবহারের জন্য ফেসবুক শুধু বিশাল সমালোচনার মুখোমুখি হয়নি, বরং তাদের শেয়ারমূল্যেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে।
আইনি ঝুঁকি এবং এর প্রভাব
বিশ্বব্যাপী কঠোর ডেটা সুরক্ষা আইন কার্যকর হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন ( জিডিপিআর) এবং ক্যালিফোর্নিয়া কনজিউমার প্রাইভেসি অ্যাক্ট (সিসিপিএ)-এর মতো আইন প্রতিষ্ঠানের ডেটা ব্যবস্থাপনার ওপর ইতি-মধ্যেই বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ২০২০ সালে অ্যামাজন-কে জিডিপিআর আইন লঙ্ঘনের জন্য প্রায় ৭৪৬ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া গুগোল এবং ফেসবুক-এর মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশাল জরিমানার সম্মুখীন হয়েছে। এই ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য কোম্পানি গুলোর মধ্যেও এক ধরণের ভয় তৈরি করে দেয়, সেই সকল প্রতিষ্ঠান গুলোও তাদের ডাটা নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। গুগোল এবং ফেসবুক এই জরিমানার ঘটনা প্রমাণ করে যে, আইনি বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করলে তার খেসারত হতে পারে ব্যবসার জন্য ধ্বংসাত্মক।

ডেটা প্রাইভেসির আইনি ঝুঁকি এবং এটি আধুনিক ব্যবসার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব। | ছবি সংগৃহীত।
ডেটা সুরক্ষার সেরা পদ্ধতি
ডেটা সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কিছু কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- ডেটা এনক্রিপশন: গ্রাহকের তথ্য এনক্রিপ্ট করা এবং সাইবার আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখা। মূলত এই কাজের জন্যই ডেটা সুরক্ষার এতটা গুরুত্ব পূর্ণ।
- অ্যাকসেস নিয়ন্ত্রণ: শুধুমাত্র অনুমোদিত কর্মীদের ডেটা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া।
- ডেটা মিনিমাইজেশন: প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা এবং অপ্রয়োজনীয় ডেটা সংরক্ষণ এড়ানো।
- ডেটা রিটেনশন নীতি: নির্দিষ্ট সময় পর তথ্য একা একাই মুছে ফেলা হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
বাংলাদেশে তথ্য গোপনীয়তা সুরক্ষার জন্য “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮” কার্যকর করা হয়। এই আইন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সাইবার অপরাধ দমন এবং ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর অধীনে ব্যক্তিগত তথ্যের অনুপ্রবেশ, অপব্যবহার বা অননুমোদিত ব্যবহারের জন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধানও রয়েছে। এই আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে, তবে তার সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইন সাইবার নিরাপত্তার একটি মাইলফলক হলেও কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার উন্নতি।
বাংলাদেশে ডেটা সুরক্ষার উদাহরণ
বাংলাদেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ তাদের গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। প্রতিটি লেনদেনের জন্য ওটিপি চালু করা এবং ডেটা এনক্রিপশন নিশ্চিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো বিকাশের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়িয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটির সেবা গ্রহণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে ডেটা প্রাইভেসি নিশ্চিত করার বিভিন্ন উদাহরণ ও তার প্রয়োগ। | ছবি সংগৃহীত।
প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার হাতিয়ার
ডেটা প্রাইভেসি রক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপেল তাদের গ্রাহকের ডেটা সুরক্ষার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আস্থা অর্জন করেছে। তাদের স্লোগান “আপনার আইফোনে যা ঘটে, তা আইফোনেই থাকে।” শুধু মার্কেটিং নয়; এটি তাদের গ্রাহকদের প্রতি দায়বদ্ধতারই প্রতিফলন।
ডেটা প্রাইভেসি এখন আর বিলাসিতা নয়; এটি ব্যবসার মৌলিক চাহিদা। আপনার ব্যবসার উন্নতি করতে চাইলে, গ্রাহকদের আস্থা অর্জন, আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলা এবং প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য ডেটা সুরক্ষায় বিনিয়োগ করা অপরিহার্য।
আপনার প্রতিষ্ঠান যদি সঠিক ডেটা সুরক্ষা কৌশল গ্রহণ করে, তাহলে এটি শুধু আইনি ঝুঁকি কমাবে না; বরং এটি আপনার ব্যবসার সুনাম রক্ষার শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠবে। এখনই সময়, ডেটা সুরক্ষাকে আপনার প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখার।
Comments