গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তাহসিন
প্রয়োজন মেটানো বা শখ পূরণ, যেই জিনিসটির ব্যবহার আমাদের প্রতিনিয়ত করতে হয় তা হল টাকা। একেক দেশের একেক রকম টাকা, তার সাথে জড়িত বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ‘টাকা’। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের নিজস্ব মুদ্রার প্রতিষ্ঠা ও ব্যবহার জাতীয় ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু এই ইতিহাস আমরা কজনই বা জানি! টাকার ইতিহাসের শুরু ১৯৭১ সালে, যখন পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। তখনই নতুন একটি অর্থনৈতিক পরিচয় তৈরির তাগিদ আসে। স্ট্যাম্পযুক্ত নোট ছিল দেশের আত্মপরিচয়ের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। যদিও এই স্ট্যাম্পযুক্ত মুদ্রা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি, তবুও এটি ছিল স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত বাঙালিদের প্রতিরোধের প্রতীক।
স্বাধীনতার আগের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অর্থনৈতিক লেনদেনের সময় একটা সংকট দেখা দেয়। পাকিস্তানি রুপি তখনো প্রচলিত ছিল, কিন্তু তা দেশের স্বাধীনতা চেতনার পরিপন্থী ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এবং সাধারণ মানুষ তখন পাকিস্তানি রুপির ওপর “বাংলাদেশ” স্ট্যাম্প ব্যবহার করে নিজেদের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতেন, যা ছিল দেশপ্রেমের প্রতীক। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৮ জুন পাকিস্তান সরকার সেই স্ট্যাম্পযুক্ত নোটকে বেআইনি ঘোষণা করে। তবু এটিই ছিল বাঙালিদের কাছে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রাথমিক সূচনা।
১৯৭২ সালে টাকার আত্মপ্রকাশ
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রথম ধাপ ছিল নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন। তাই স্বাধীনতা অর্জনের পর নতুন জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে নিজস্ব মুদ্রা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ‘বাংলাদেশি টাকা’ চালু করে। প্রথম দিকে ১, ৫, ১০, ১০০ টাকার নোট বাজারে আসে, যেগুলো ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ছাপা হয়।
এই নোটগুলোতে দেশের মানচিত্রের প্রতীক এবং বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীদের তৈরি নকশা ছিল। বিশেষ করে ১ টাকার নোটে বাংলাদেশের মানচিত্রের প্রতিচ্ছবি এবং ৫ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ছিল। এটি ছিল দেশের জাতীয় নেতৃত্ব ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক।
প্রথম নোটের নকশা ও শিল্পীদের ভূমিকা
যখন নতুন নোট আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, চিন্তায় আসে কেমন হবে নতুন নোটের ডিজাইন! সদ্য স্বাধীন একটি দেশের মুদ্রা ডিজাইনের দায়িত্ব কে নেবে? প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান ও চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের কমিটিকে নতুন নোটের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে কামরুল হাসান খবর পান চারুকলার শিল্পী কে জি মুস্তাফার কথা, যিনি করাচির সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মুস্তাফাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আ ন ম হামিদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যান। সেখানেই মুস্তাফাকে নতুন নোটের নকশা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুস্তাফা প্রথমে পাঁচ টাকার নোটের দুটি সংস্করণ নিয়ে কাজ শুরু করেন। দুই সপ্তাহ পর তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে তার নকশা জমা দেন। তিনি নকশাটি দেখে খুব সন্তুষ্ট হন এবং তিনি এটি প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে দেখান। অবশেষে নকশাগুলো স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নোট ছাপানোর অনুমতি দেন এবং এর জন্য চুক্তি দেওয়া হয় ব্রিটিশ কোম্পানি টমাস দে লা রুকে। শিল্পীরা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নোটের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই সময়ের নকশাগুলো শুধু অর্থনৈতিক মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অমূল্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৭৩ সালে নতুন নোটের নিরাপত্তা সংকট
নোটগুলো ভারতে ছাপানো হওয়ায় শুরুর দিকে নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল। তখন বাজারে জাল নোট ছড়াতে শুরু করে , যা নতুন অর্থনীতির জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত ব্যবস্থা নেয় । ১৯৭৩ সালের ১ মে নোট বাতিল ঘোষণা করে এবং নতুন নকশায় নোট চালু করে। এই নতুন নকশাগুলোতে আধুনিক নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংযুক্ত করা হয়, যা জালিয়াতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
দেশের নিজস্ব টাঁকশাল ও কাগুজে মুদ্রার বিকাশ
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম নিজস্ব টাঁকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশি মুদ্রা বিদেশে ছাপানো হতো, যা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। টাঁকশালের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরেই মুদ্রা উৎপাদন শুরু হয়। এর ফলে মুদ্রার মান এবং নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়। ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০, এবং ১০০০ টাকার নোট চালু হয়। এই মুদ্রাগুলোতে দেশের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে তুলে ধরা হয়, যেমন সুন্দরবন, শহীদ মিনার, জাতীয় সংসদ ভবনের প্রতিচ্ছবি।
ডিজিটাল যুগে মুদ্রার বিকাশ
একুশ শতকের সূচনায় বাংলাদেশে কাগুজে মুদ্রার পাশাপাশি ডিজিটাল লেনদেনের প্রচলন শুরু হয়। বিশেষ করে ২০১১ সালে বিকাশ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে, যা অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটায়।টাকার পাশাপাশি মোবাইল লেনদেনও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশি টাকার ইতিহাস দেশের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার এক মহাকাব্যিক প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল মুদ্রা নয়, বরং জাতির স্বাধীনতার প্রতীক ও গৌরবের পরিচায়ক।
Comments