ইনোভেশনস এন্ড ট্রেন্ডস

ব্লকচেইন ও বিকেন্দ্রীকরণ: ডিজিটাল বিশ্বের নতুন নিয়ম।

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া

বিকেন্দ্রীকৃত প্রযুক্তি হল এমন প্রযুক্তি যা কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে অপারেট করে। এটি ব্যবহারকারীদের ক্ষমতায়ন করে এবং তাদের হাতে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়। আর ব্লকচেইন প্রযুক্তি হলো বিকেন্দ্রীকৃত প্রযুক্তির একটি উদাহরণ। এটি একটি অপরিবর্তনীয় স্বচ্ছ ডিজিটাল লেনদেনের রেকর্ড যা বিকেন্দ্রীকৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেখানে কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ নেই।

চলুন এই দুটি প্রযুক্তি সম্পর্কে পৃথকভাবে জেনে আসি।

বিকেন্দ্রীকরণ কি?

বিকেন্দ্রীকরণ হল কোনো কিছুর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে এসে বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতা বণ্টন করার প্রক্রিয়া। যেমন ধরুন, কোনো কাজের দায়িত্ব একজন ব্যক্তির হাতে না রেখে, বিভিন্ন দল বা ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া। তাই এটিকে আবার কেন্দ্রীকরণের বিপরীতও বলা যায়।

কারণ কেন্দ্রীকরণে সবকিছু এক জায়গায় থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন- একটি কোম্পানির সব কাজই মূল অফিস থেকে পরিচালিত হয়। এতে সমস্যা হলো যদি মূল অফিসে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে সমগ্র কোম্পানির কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইন্টারনেট হল বিকেন্দ্রীকরণের একটি চমৎকার উদাহরণ। ইন্টারনেট তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতেও যাতে এটি চালু থাকে। এতে কোনো একটি অংশ বন্ধ হয়ে গেলেও, তথ্য অন্য পথে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। এজন্যই ইন্টারনেট বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব।

বিকেন্দ্রীকরণ কি? ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষমতার বণ্টন।

বিকেন্দ্রীকরণ কি? ব্লকচেইন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শক্তির সুষম বণ্টন ও স্বচ্ছতা। | ছবি সংগৃহীত।

এছাড়াও আরো একটি সহজ উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি হবে এমন –

যদি আপনার বাড়িতে সব কাজ আপনি নিজেই করে থাকেন , যেমন- রান্না, পরিষ্কার, বাচ্চা দেখা, সব আপনার দায়িত্ব। এটাই কেন্দ্রীকরণ। কিন্তু যদি আপনি পরিবারের সবাইকে কাজে সাহায্য করতে বলেন, তাহলে তা হবে বিকেন্দ্রীকরণ। এতে কিন্তু আপনার কাজের চাপ কমে যাবে এবং কাজও বেশ দ্রুত শেষ হবে।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি কি?

সহজভাবে বললে, ব্লকচেইন হল একটি বিশেষ ধরনের ডিজিটাল হিসাবের বই, যেখানে তথ্য এমনভাবে রেকর্ড করা হয় যে তা পরিবর্তন করা, হ্যাক করা বা ভুলভাবে পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। এটি একটিবিকেন্দ্রীকৃতহিসাবের বই, যার অর্থ এই যে, এই তথ্য এক জায়গায় নয় বরংচ নেটওয়ার্কে যুক্ত অনেকগুলো কম্পিউটারে একইভাবে সংরক্ষিত থাকে।

এইব্লকচেইননামক হিসাবের বইটিতে প্রতিটি লেনদেনের তথ্য একটিব্লকহিসেবে সংরক্ষিত হয় এবং এই সবব্লকপরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে একটিচেইনবা শৃঙ্খল গঠন করে। এই হিসাবের বইয়ে প্রতিটি লেনদেনের জন্য একটি ডিজিটাল স্বাক্ষর থাকে, যা নিশ্চিত করে যে লেনদেনটি সঠিক এবং কেউ তা পরিবর্তন করতে পারবে না। ফলে, এই হিসাবের বইয়ে সংরক্ষিত তথ্য অত্যন্ত নিরাপদ।

আরও সহজ করে বললে, এটি এমন যেন একটি গুগল শীট, যেটি নেটওয়ার্কে থাকা অনেকগুলো কম্পিউটারে একইভাবে শেয়ার করা আছে। এই শীটে সকল লেনদেনের তথ্য রেকর্ড করা থাকে। যেহেতু এটি অনেকগুলো কম্পিউটারে রয়েছে, তাই কেউ এতে ভুল তথ্য ঢোকাতে পারে না বা তথ্য পরিবর্তন করতে পারে না।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি কি? বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ডেটা নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার উদাহরণ।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি কি? ব্লকচেইন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ডেটা ব্যবস্থাপনার নতুন দিগন্ত। | ছবি সংগৃহীত।

ব্লকচেইনে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা

ব্লকচেইনে কেন্দ্রীকরণ বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা বুঝতে, একটি জাতীয় মুদ্রার কথাই কল্পনা করুন এই মুদ্রাটি একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে কয়েকজন নির্দিষ্ট লোকেরই ক্ষমতা থাকে মুদ্রাটির পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ তদারকি করার। এটাই হল কেন্দ্রীকরণের উদাহরণ।

আর এর বিপরীত হল বিকেন্দ্রীকরণ। এখানে কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক বা কাঠামোর মালিকানা, পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো, যেমন- বিটকয়েন ইথেরিয়ামের ইথার, এগুলো বিকেন্দ্রীকৃত।

কেন্দ্রীয় মুদ্রার বিপরীতে, বিকেন্দ্রীকৃত ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং এগুলোর নিজস্ব প্রোগ্রামিং কোড এবং মুদ্রানীতি নির্ধারিত হয় সেগুলোর সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের দ্বারা।

ব্লকচেইনে, বিকেন্দ্রীকরণ মানেই হল নিয়ন্ত্রণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কোনো একটি কেন্দ্রীয় সত্ত্বা (ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, অথবা এদের সমষ্টি) থেকে সরিয়ে নিয়ে একটি বিকেন্দ্রীকৃত নেটওয়ার্কে স্থানান্তর করা। এই বিকেন্দ্রীকৃত নেটওয়ার্কগুলোর লক্ষ্য হল অংশগ্রহণকারীদের একে অপরের প্রতি বিশ্বাসের মাত্রা কমানো এবং নেটওয়ার্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে এমনভাবে কেউ যাতে কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা।

ব্লকচেইনে বিকেন্দ্রীকরণের ধরণঃ

ব্লকচেইনে সাধারণত তিন ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ দেখায়-

১। সবকিছু একজনের হাতে: একজনই সব নিয়ন্ত্রণ করে।

২। কয়েকজন মিলে: কয়েকজন মিলে নিয়ন্ত্রণ করে।

৩। কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না: সবার সমান অধিকার।

ব্লকচেইনে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা; ডেটা ব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার বণ্টনের তুলনা।

ব্লকচেইনে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা; ব্লকচেইন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সুশাসনের উদাহরণ। | ছবি সংগৃহীত।

এছাড়াও, বিকেন্দ্রীকরণের আরো কিছু ধরন রয়েছে-

জায়গা ভিত্তিক: ব্লকচেইন সার্ভারগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকে, যাতে কোনো এক জায়গায় সমস্যা হলেও সিস্টেম চলতে থাকে।

লেনদেন ভিত্তিক: ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ ও স্বচ্ছ করার জন্য এই ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ।

নিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক: কতজন লোক বা সংস্থা সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে, সে অনুযায়ী বিকেন্দ্রীকরণের মাত্রা নির্ধারিত হয়। কম লোক নিয়ন্ত্রণ করলে, বিকেন্দ্রীকরণ বেশি হয়।

কারা বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা দিয়ে ব্লকচেইন অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে?

ব্লকচেইন ব্যবহার করে যারা অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে, তারা সবসময় সম্পূর্ণরূপে বিকেন্দ্রীকৃত করে না। এটি নির্ভর করে কতটা নির্ভরযোগ্য, কতটা পরিপক্ক এবং কতটা ভালোভাবে তৈরি করা হয়েছে তার উপর।

উদাহরণস্বরূপ, অনেক DAO-এর বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকৃত থাকে: অরাকলস (যা স্মার্ট চুক্তিকে বহিরাগত তথ্য সরবরাহ করে) আংশিকভাবে বিকেন্দ্রীকৃত হতে পারে, স্মার্ট চুক্তি সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীভূত হতে পারে, যখন পরামিতি সামঞ্জস্য করার জন্য পরিচালনা প্রক্রিয়া সম্প্রদায়চালিত এবং বিকেন্দ্রীকৃত।

এখন বিভিন্ন ধরনের সংস্থা ব্লকচেইন ব্যবহার করে নতুন সমাধান খুঁজে বের করছে এবং সেগুলো ব্যবহার করছে।

কারা বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা দিয়ে ব্লকচেইন অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে? নতুন উদ্ভাবনের ধারণা।

কারা বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা দিয়ে ব্লকচেইন অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে? ব্লকচেইন ও বিকেন্দ্রীকরণের ভূমিকা উদ্ভাবনী উন্নয়নে। | ছবি সংগৃহীত।

যারা তাদের কাজে এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান তাদের জন্য “ব্লকচেইন প্রফেশনাল সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম” নামে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স রয়েছে এই কোর্সে আপনি ব্লকচেইন কীভাবে কাজ করে, এর গঠন কেমন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন এতে আপনি আইটি শিল্পের জন্য নতুন ধরনের সমাধান তৈরি করতে শিখতে পারবেন

এই প্রশিক্ষণে আপনি ট্রাফল, হাইপারলেজার, ইথেরিয়াম সহ বিভিন্ন ধরনের ব্লকচেইন টুলস ব্যবহার করে অ্যাপ্লিকেশন এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করতে শিখবেন

“তথ্যসূত্র”

সিংগেল টাস্কিং নাকি মাল্টিটাস্কিং? কাজের দক্ষতা বাড়াতে কোনটি বেছে নিবেন?

Previous article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *