গ্লোবাল ট্রেড

চীনের হাতে আফ্রিকার খনিজ শিল্পের সিংহভাগ

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা ইসফাকুল কবির

আফ্রিকা প্রাকৃতিক সম্পদ ভরপুর একটি মহাদেশ হিসেবে পরিচিত। এই মহাদেশে রয়েছে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান খনিজ সম্পদ, যেমন লোহা, তামা, কোবাল্ট, স্বর্ণ, এবং হীরা সহ আরও অনেক মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এগুলো বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন আপনার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ডিভাইস এমনকি বর্তমান ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরিতেও বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি আফ্রিকার এই খনির উপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা কোম্পানিগুলোর প্রভাব আফ্রিকার এই খনির শিল্পের উপর দিন দিন বেড়েয় চলেছে। চীনের আফ্রিকার উপর এই নিয়ন্ত্রন শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও লক্ষণীয়। কিন্তু কেন চীনা কোম্পানিগুলো আফ্রিকার খনির শিল্পে এমন আধিপত্য বিস্তার? 

১. চীনের খনিজ সম্পদের চাহিদা এবং আফ্রিকার ভূমিকা

চীনা অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনীতি গুলোর একটি। ইস্পাত উৎপাদনের জন্য লোহা, ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য তামা, এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি এবং মোবাইলের ব্যাটারি তৈরির জন্য কোবাল্ট—এমন বহু খনিজ সম্পদের জন্য চীন আফ্রিকার উপর নির্ভরশীল। চীন বিশ্বব্যাপী কোবাল্ট সরবরাহের প্রায় ৬০% নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর একটি বড় অংশ আফ্রিকার দেশ কঙ্গো থেকে আসে।

আফ্রিকার ভূমি খনিজ সম্পদে ভরপুর হলেও এটি তুলনামূলকভাবে উন্নত প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অভাবে নিজস্ব সম্পদ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণের কাজে পিছিয়ে রয়েছে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে চীনা কোম্পানিগুলো। তারা আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে আফ্রিকার খনিজ শিল্পে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।

আফ্রিকার খনিজ শিল্পে চীনের খনিজ সম্পদের চাহিদা ও ভূমিকার প্রভাব।

২. চীনা বিনিয়োগ কৌশল: অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ঋণ কূটনীতি

চীনা কোম্পানিগুলো শুধু খনিজ উত্তোলনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তারা আফ্রিকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেও মনোযোগ দিয়েছে। চীনা সরকার এবং কোম্পানিগুলো আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রেলপথ, সড়ক, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, এবং সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। কঙ্গোতে চীনা কোম্পানিগুলো কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের মাধ্যমে কঙ্গ সরকারের আস্থা অর্জন করে। যার মধ্যমে চীনের কোম্পানিগুলোর সাথে কঙ্গোর সরকার এমন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য একদিকে চীনা কোম্পানিগুলোকে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে, অন্যদিকে কঙ্গো সরকারের জন্য রাস্তা, রেলপথ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং বন্দর নির্মাণের সুবিধা প্রদান করা হবে।

এ ব্যপারে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি বলেন “চীন আফ্রিকার খনিজ শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে।” অন্যদিকে কঙ্গোতে অবস্থানরত সাবেক চীনা  রাষ্ট্রদূত ঝাও চাংপিং বলেন, “চীনের খনিজ খাতে সম্পৃক্ততা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থ নয়, বরং আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে একটি বৃহত্তর উন্নয়ন অংশীদারিত্বের অংশ।”

আফ্রিকার খনিজ শিল্পে চীনা বিনিয়োগ কৌশল, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ঋণ কূটনীতির প্রভাব।

৩. স্বল্পমূল্যের শ্রম এবং উৎপাদন খরচ হ্রাস

আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশেই তুলনামূলক গরীব রাষ্ট্র হওয়াতে সেখানে শ্রমিকও পাওয়া যায় অনেক অল্প টাকায়। চীনা কোম্পানিগুলো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের স্বার্থ আদায় করে আনছে। চীনা কোম্পানিগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে খনিজ সম্পদ উত্তোলন প্রক্রিয়া আরও বেশি সহজ করে তুলেছে। একটি বিতর্কিত তৈরি হচ্ছে চারিদিকে যে, চীন নিয়ন্ত্রিত খনিগুলোতে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় কাজ করছে সেখানকার শ্রমিকরা। প্রায় সময় সেই সকল খনি থেকে শ্রমিকদের মৃত্যুর সংবাদ আসে। 

৪. রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং প্রভাব

চীন এবং আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। চীন তাদের কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে চীনা কোম্পানিগুলো সহজেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। চীন আফ্রিকান ইউনিয়ন এর সদর দপ্তর নির্মাণে ২০০ মিলিয়ন ডলার দান করে। এই দান চীনের আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার অংশ। এটি চীনের “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ”-এর আওতায় আফ্রিকায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের একটি উদাহরণ, তবে কিছু সমালোচক মনে করেন যে এটি আফ্রিকায় চীনের প্রভাব বিস্তারের কৌশল মাত্র।

এছাড়া, চীন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পের মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রদান করে আসছে। ঋণ পরিশোধের শর্ত হিসেবে চীনা কোম্পানিগুলোকে অনেক সময় আফ্রিকার খনিজ শিল্পে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

আফ্রিকার খনিজ শিল্পে রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং চীনের প্রভাব।

৫. পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব: সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ

চীনা কোম্পানিগুলোর খনিজ উত্তোলন কার্যক্রম আফ্রিকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একদিকে আফ্রিকার জনবল খাতের উন্নয়নের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে, পরিবেশগত ক্ষতি, স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর ব্যপক প্রভাব বিস্তার, এবং সম্পদের অতি-শোষণ অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে দেশগুলোতে। চীনা কোম্পানির কার্যক্রমের ফলে কঙ্গোতে কোবাল্ট উত্তোলনের কারণে পরিবেশ দূষণ এবং স্থানীয় কৃষি জমি ধ্বংস হচ্ছে। 

চীনা কোম্পানিগুলোর আফ্রিকার খনিজ শিল্পে আধিপত্য একটি জটিল এবং বহুমুখী ইস্যু। এটি চীনের অর্থনৈতিক প্রয়োজন, বিনিয়োগ কৌশল, এবং রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যদিও এই আধিপত্য আফ্রিকার জন্য উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করছে, তবে এর সঙ্গে নির্ভরশীলতা, পরিবেশগত ক্ষতি, এবং স্থানীয় সম্পদের উপর বিদেশি নিয়ন্ত্রণের মতো সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর উচিত তাদের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করা। কেবলমাত্র দক্ষ প্রশাসন এবং ন্যায্য বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমেই তারা এই আধিপত্যের ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগিয়ে নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনতে পারবে।

“তথ্যসূত্র”

ব্যবসায়িক সাফল্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে ডেটা-চালিত মার্কেটিং

Previous article

যেভাবে ডেটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে সফল উদ্যোক্তা হবেন

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *