গ্লোবাল ট্রেড

চীনের ঋণ ফাঁদে বিপদে থাকা দেশের অবস্থা

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির

গত কয়েক বছরে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের “ঋণ ফাঁদ”। মূলত চীন বিভিন্ন দেশে উন্নয়নের বুলি উড়িয়ে সেই দেশ গুলোর মাথায় একটা বড় বোঝা চাপিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে চীনের এই ঋণ ফাঁদে পা দিয়েছে মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্থান এবং কেনিয়ার মত আফ্রিকার দেশগুলো। চীন বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বড় অংকের ঋণ দেয়। সেই দেশে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য এবং পরবর্তীতে যখন এসব দেশ তাদের ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয়, চীন এসব দেশ থেকে কৌশলগত রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেমন বন্দর, বিমানবন্দর বা রেলওয়ে নিয়ে নেয়। কিন্তু চীন কেন এমন করছে দেশ গুলোর সাথে? চলুন জেনে নেই আজকের এই প্রতিবেদনে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ

২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর কার্যক্রম শুরু করে। এই প্রকল্পের মধ্যে চীন একটি বিশাল অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যা শুধু চীনের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকবে না। চীন তাদের প্রাচীন সিল্ক রুটকে নতুন করে কার্যকর করতে চায়। তাই চীন, এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে চীনকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। মূলত চীনের প্রাচীন সিল্ক রোডের অনুরূপ একটি বাণিজ্যিক পথ তৈরি করাই তাদের উদ্দেশ্যে। এই প্রকল্পে মধ্যে চীন প্রায় ১৪০টি দেশেকে সমন্বয় করেছে। সে সকল দেশের মধ্যে সড়ক, রেলপথ, বন্দর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে চীন আর্থিক, পরিকল্পনা ভিত্তিক এবং ম্যান পাওয়ার দিয়ে সহয়তা করে থাকে। অবকাঠামো নির্মাণে দেশগুলোকে যে বিশাল অংকের টাকা দেওয়া হয় তা মূলত ঋণ। আর এই থেকেই যত সমস্যার শুরু হয়। যদিও এই প্রকল্পগুলো অনেক দেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ ভুমিকা রেখেছে। তবে বেশির ভাগ দেশই সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় সেই দেশগুলোতে চীন একটা কৌশলগত সুবিধা লাভ করছে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চীনের ঋণ ফাঁদে পড়া দেশগুলোর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

কোন কোন দেশ চীনের এই ঋণ ফাঁদে পা দিয়েছে?

অনেক দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনের দেনা ফাঁদে পড়েছে:

১. শ্রীলঙ্কা

চীন থেকে অর্থ সহায়তায় বিপদে পরছে এমন দেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শ্রীলঙ্কা। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা তাদের হামবানটোটা বন্দর চীনকে ৯৯ বছরের জন্য ভাড়া দিতে বাধ্য হয়, কারণ দেশটি চীন থেকে নেওয়া ১.৪ বিলিয়ন ঋণ পরিশোধ করতে নিজেদের অক্ষম ঘোষণা করে। এর ফলে চীন দ্বীপ রাষ্ট্রটির উপর কৌশলগত সম্পদ নিয়ন্ত্রণের সুবিধা পায়। 

২. পাকিস্তান

চীনের সাথে পাকিস্থানের চিরকালই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক পাড়ায় শোনা যায় পারমাণবিক শক্তিধর হতে চীন পাকিস্তান সহায়তা করেছিল। সেই পরম বন্ধু পাকিস্থানেকেও এই ঋণ ট্র্যাপের মধ্যে নিয়ে এসেছে চীন। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের মাধ্য দিয়ে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন পাকিস্তানে ৬০ বিলিয়ন বিনিয়োগ করে। পাকিস্থানে ইমরান খানের সরকার পতনের পর ২০২২ সালে দেশটির মানুষ তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির দেখে। যে কারণে দেশটির জন্য বৈদেশিক ঋণের বোঝা আরও বেশি মাত্রায় বেড়ে যায়। তবে পাকিস্তানের ঋণের চাপ ক্রমবর্ধমান হওয়ায় সেখানে চীনের কিছু প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। যে কারণে পাকিস্থান তাদের ঋণ পরিশোধে সমস্যায় পড়ছে।

৩. মালদ্বীপ

মালদ্বীপও চীনের ঋণে বিপদগ্রস্ত, চিনের তাদের ঋণ ১.৩ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে ২০১৮ সালে। মালদ্বীপের সরকার অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য চীন থেকে ঋণ নিয়েছিল, কিন্তু সময়মত ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় মালদ্বীপ  এবং এর মাধ্যমে চীন, মালদ্বীপের উপর এক কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ করতে করতে সক্ষম হয়। 

৪. মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়া ২০১৮ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের বিপুল আকারের ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। দেশটিতে ২০ বিলিয়ন ডলারের রেলওয়ে প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায় অর্থের অভবে। যদিও পরবর্তীতে নির্মাণকাজ পুনর্বিবেচনা চালু করা হয়েছিল। তবে মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো চীনের ঋণের কারণে একটি চক্রে আটকা পড়তে পরেছে।

৫. কেনিয়া

কেনিয়া তার স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলওয়ে প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে ৩.২ বিলিয়ন ঋণ নিয়েছিল। এই প্রকল্পে দায়বদ্ধতা বাড়ানোর কারণে কেনিয়া তাদের ঋণ পরিশোধে সমস্যায় পড়ছে। তাই কেনিয়াতে চীনকে একধরণের কৌশলগত বন্ধু বানিয়ে ফেলে।

দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ চীনের ঋণ ফাঁদে পড়েছে।

দেনা ফাঁদ কিভাবে কাজ করে?

চীন সাধারণত নিম্ন সুদের ঋণ প্রদান করে থাকে বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য, যা দীর্ঘমেয়াদী এবং দেশটির উন্নয়নে সহায়ক বলে দাবি করা হয়। তবে এই ঋণগুলো চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলি থেকে প্রদান করা হয়, এবং এর শর্তাবলীতে চীনের ঠিকাদার এবং শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়। ফলে প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগ অর্থ চীনেই থেকে যায়।

যখন ঋণ পরিশোধে সমস্যা সৃষ্টি হয়, চীন তখন কৌশলগত সম্পদ যেমন বন্দর বা রেলওয়ে তাদের নিজেরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে। এটি এমন একটি কৌশল যেখানে চীন শুধুমাত্র ঋণের ঋণদাতা হিসেবে নয়, বরং একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের স্থান শক্তিশালী করতে পারে।

চীনের বৃহত্তর বৈশ্বিক কৌশল

চীনের লক্ষ্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে বৈশ্বিক ক্ষমতা এবং প্রভাব বিস্তার। চীন এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, তেল, এবং কৃষি সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পেতে চাইছে, পাশাপাশি কৌশলগত অবস্থানগুলো যেমন সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দরও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এছাড়াও, চীন “মেড ইন চায়না ২০২৫” পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশ্বের শীর্ষে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে চলেছে। 

সমালোচনা এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

চীনের দেনা ফাঁদ কৌশল বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে। তারা এটি এক ধরনের আর্থিক উপনিবেশবাদ হিসেবে দেখছে, যা এসব দেশকে চীনের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলছে। অতিরিক্ত ঋণের চাপ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে পড়া সত্ত্বেও, চীন তাদের ঋণ শর্তগুলি শিথীল করার বা পুনঃবিবেচনার প্রস্তাব দেয় না।

চীনের ঋণ ফাঁদ নিয়ে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা।

দেনা ফাঁদ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব

চীনের দেনা ফাঁদ কৌশল একটি অত্যন্ত আলোচিত এবং উদ্বেগজনক বিষয়, যা বিশ্বের বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যদিও এটি অবকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য করছে, কিন্তু এর ফলে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি চীনের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, যা ভবিষ্যৎতে তাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে। এই ধরনের ঋণের কৌশল সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং এই দেশগুলোর আর্থিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে। চীনের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কৌশল আগামী দশকগুলোতে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক চিত্র পরিবর্তন করে দিতে পারে।

“তথ্যসূত্র”

প্রিমিয়াম গ্রাহক অভিজ্ঞতা নিশ্চিতে এআই ব্যবহার করছে স্টারবাকস

Previous article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *