Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া |
এক যুগ আগেও কিন্তু স্মার্টফোন হাতে নিয়ে এখন যেসব কাজ করা সম্ভব হচ্ছে, তা কল্পনাও করা যেত না। আর আজ এক ক্লিকেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যেকোনো মুহুর্তেই আমরা পৌঁছে যেতে পারছি। এমন এক সময় ছিল যখন বাংলাদেশের তরুণরা বিদেশে চাকরির স্বপ্ন দেখত। কিন্তু আজ তারা দেশে বসেই সে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাচ্ছে। আর এই সকল ডিজিটাল পরিবর্তনের মূলেই রয়েছে স্টার্টআপ।
তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানে সমৃদ্ধ তরুণ উদ্যোক্তাদের ওপর ভর দিয়ে দেশে দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে স্টার্টআপের দিগন্ত। যা দেশে নিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ। ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৭৭টি স্টার্টআপ কোম্পানিতে ৯০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগই ৮৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি ৬৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীরা এবং স্টার্টআপে দেশীয় বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ৭ শতাংশ।
এছাড়াও কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ লাখেরও বেশি মানুষের। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও কর্মীদের প্রায় সবাই তরুণ। তবে দেশের সম্ভাবনাময় এ খাতের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন একটি স্টার্টআপবান্ধব পরিবেশ। স্টার্টআপ গঠন ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সুযোগ–সুবিধা সহজেই পাবেন তরুণ উদ্যোক্তারা। যা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশে স্টার্টআপের ইতিহাস এক দশকের বেশি পুরোনো নয়। মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ বাংলাদেশের প্রথম সফল স্টার্টআপ ,যা ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আর ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে স্টার্টআপের ধারণা পরিচিতি পেতে শুরু করে। এরপর একে একে আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান উঠে আসে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ৭.১% এর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি দেশে স্টার্টআপের জন্যও একটি সমৃদ্ধ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- ডিজিটাল বিপ্লব, যেখানে ১২ কোটি ৬০ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে ৭৫% ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এই বিশাল সংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী একটি বৃহৎ ডিজিটাল বাজার গড়ে তুলছে।
তবে করোনা মহামারির সময় ব্যাপক অনলাইন নির্ভরশীলতার কারণে ২০২০ সাল থেকে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ দ্রুত বেড়ে যায়। বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশীয় কিছু উদ্যোক্তা এগিয়ে আসায় স্টার্টআপের বাজার সম্প্রসারিত হতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্টার্টআপের জন্ম হওয়ায় এটিকে বলা হয় স্টার্টআপের স্বর্গভূমি। যেখানে সত্তর হাজারেরও বেশি স্টার্টআপের জন্ম হয়। আর এই দিকে তাকালেই দেখা যাবে কীভাবে টেক স্টার্টআপ একটি দেশের অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করতে পারে। আর স্টার্টআপবান্ধব পরিবেশ থাকার কারণেই এসব সম্ভব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ এর মূল চালিকাশক্তি হলো সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা।
বাংলাদেশে স্টার্টআপসমূহ
বাংলাদেশে স্টার্টআপদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -বিডিজবস, চালডাল, ফুড পান্ডা, পাঠাও, রকমারি, সেবা, শপআপ পোস্টার বয় ইত্যাদি। এছাড়া ই–কমার্সে আজকের ডিল, সিন্দবাদ, খাস ফুড, সাজগোজ, ক্লিক বিডি, হাংরিনাকি, স্টাইলাইন, প্রিয় শপ অথবা লজিস্টিক ও পরিবহনে লুপ, পেপার ফ্লাই, ট্রাক লাগবে, ইকুরিয়ার; মার্কেট প্লেসে হ্যালো টাস্ক, হ্যান্ডি মামা; ফিনটেকে পেওয়েল, আমারপে; এডুটেকে এসো শিখি, রেপ্টো; কন্টেন্টে মায়া, জিএন্ডআর, বঙ্গ; হেলথ টেকে অলোয়েল, প্রভা, ডিমস, সিমেড; এগ্রিটেকে ড্রিঙ্ক ওয়েল, ফার্মারহাব, আইফার্মার; ডিপ টেকে ইথার, বণ্টন, গেজ; সফটওয়্যারে ব্রেনস্টেশন২৩, রাইটব্রেন, কাজ, বাড়ি কই, নেসেনিয়া, ফিল্ডবাজ, জুমসেপার উল্লেখ্য।
আশা করা যায়, এদের মধ্য থেকে হয়তো উঠে আসবে পরবর্তী ইউনিকর্ন বা বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ। প্রচলিত ব্যবসার কাছে আরও দ্রুত লাভের মুখ দেখার প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু ই–কমার্স অনেক দ্রুত তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে, তাই লাভ আসে ধীরে ধীরে।
দেশের যেকোনো স্থান থেকে প্রয়োজনীয় মালামাল স্থানান্তরের জন্য ঘরে বসে ট্রাক ভাড়া করার সহজ উপায় এনেছে স্টার্টঅ্যাপ ‘ট্রাক লাগবে’। এই স্টার্টআপ এর যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে, দেশজুড়ে মাত্র ৫০টি ট্রাক নিয়ে। তবে তাদের বর্তমানে নিবন্ধিত ট্রাকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। দেশীয় ও বিদেশি মিলে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৪ কোটির টাকার বিনিয়োগ পেয়েছে।
এছাড়াও ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পাঠাও যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে রাইড শেয়ারিংয়ের পাশাপাশি এই ডিজিটাল সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম একের মধ্যে অধিক সেবা যেমন-, ফুড ডেলিভারি এবং ই–কমার্স লজিস্টিকস সেবাও দিচ্ছে পাঠাও। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রবৃদ্ধির সাথে সেবাগ্রহণকারী গ্রাহকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান গত বছর ৩৮ লাখ ডলার তহবিল পেয়েছে।
ডিজিটাল স্টার্টআপের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ডিজিটাল স্টার্টআপের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা দিচ্ছে। বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুব বেশি। এটি ডিজিটাল ব্যবসা শুরু করার জন্য একটি বড় বাজার তৈরি করে । বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, আর এই তরুণরাই নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে স্টার্টআপ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। বাংলাদেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম সৃষ্টির সম্ভাবনা হওয়ার মূল কারণ হলো বাংলাদেশে আইটি খাত দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া।
কিছু সমস্যা ও সমাধান
যদিও বাংলাদেশে স্টার্টআপের সম্ভাবনা অনেক, তবুও অনেক স্টার্টআপ শুরু হয়েও টিকে থাকতে পারছে না। এর মূল কারণ হলো স্টার্টআপ সম্পর্কে ব্যবসায়ীর পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। অনেকেই সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই স্টার্টআপ শুরু করে এবং পরে ব্যর্থ হয়। তাই স্টার্টআপ শুরু করার আগে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা খুবই জরুরি। ব্যবসা সম্পর্কে জানা, মার্কেটিং কৌশল শেখা এবং বিনিয়োগ সংগ্রহ করা শিখতে হবে। স্টার্টআপ শুরুর আগে একটি বিস্তারিত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। তাই স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের সাথে যুক্ত হওয়া এবং অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ।
Comments