আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এন্ড মেশিন লার্নিং

চ্যাটজিপিটি: ওপেন এআই এর নতুন দ্বার উম্মোচনের গল্প

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়শা মারিয়া

আজকের এই টেক দুনিয়ায় ঝড় তোলা চ্যাটজিপিটি বর্তমানে সব বয়সের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই আধুনিক দুনিয়ায় চ্যাটজিপিটির নাম শুনেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের এক মিলিয়ন ইউজারের মাইলফলক ছুঁতে দুই বছর সময় লাগলেও চ্যাটজিপিটি কিন্তু মাত্র পাঁচ দিনে এক মিলিয়ন ইউজারের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলে।

আপনি লক্ষ করলেই দেখবেন, চ্যাটজিপিটি’র নামের মাঝেই এর কাজের অর্থ লুকানো রয়েছে। চ্যাট শব্দের অর্থ হলো কথোপকথন বা কনভার্সেশন, জি তে জেনারেটিভ, পি তে প্রি-ট্রেইনড, টি তে ট্রান্সফরমার- সুতরাং এর পূর্ণরূপ হলো জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার।

 এটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন একটি অ্যাপলিকেশন যাকে বলা হয় ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল টুলস’। এটি ওপেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা তৈরি একটি কৃত্রিম চ্যাটবট বা আলাপচারিতা করার অ্যাপ্লিকেশন। এটি বৃহত্তর ভাষা মডেলের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা ব্যবহারকারির সাথে সংযুক্ত হয়ে অবিকল অপর একজন ব্যক্তির মতো বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারে। এটি তার তথ্যভাণ্ডারে থাকা নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাব হাজির করে। যে ফরম্যাটে বা যেভাবে চাওয়া হয়, অনেকটা সেভাবেই সে এসব উত্তর দেয়।

তবে অন্য সার্চ ইঞ্জিনের মতো চ্যাটজিপিটি এখনো লাইভ বা সরাসরি ইন্টারনেটে কাজ করে না। ইন্টারনেটে ২০২১ সাল পর্যন্ত যেসব তথ্য রয়েছে, শুধু সেগুলোই তার তথ্যভাণ্ডারে রয়েছে। চ্যাটজিপিটি চালু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি বিধায় বর্তমানে এটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিকভাবে ইংরেজি ভাষায়ই ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ভাষাও যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হবে।

২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি রিপোর্টের একটি চিত্র, যেখানে চ্যাটজিপিটি-এর বিবর্তন এবং অগ্রগতির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে।

২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি: উন্নয়ন ও অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন। | ছবি: সংগৃহীত।

ইলন মাস্ক ও স্যাম আল্টমান ২০১৫ সালে “ওপেন এআই” নামক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে যা মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু পরবর্তী ২ বছরের মাঝেই ইলন মাস্ক কোম্পানির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে এই প্রজেক্টটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে। পরবর্তীতে মাইক্রসফট কোম্পানি এতে প্রচুর পরিমাণে ইনভেস্ট করে এবং ২০২২ সালের ৩০ শে নভেম্বর এটি প্রোটো টাইপ হিসেবে বাজারে আসে।

এটি প্রচুর পরিমাণে ডেটা থেকে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। চ্যাটজিপিটি সৃষ্টিতে একের অধিক ব্যক্তির ভূমিকা থাকলেও ইলিয়া সুটস্কেভার এবং স্যাম অল্টম্যানই ছিলেন মুখ্য ব্যক্তিত্ব। এটি ‘জিপিটি’ আর্কিটেকচারের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যা ২০১৮ সালে চালু করা হয়েছিল। জিপিটি মানুষের মতো কথোপকথন এবং নিজের মতামত ও দিতে পারে যা ছিল প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণে একটি বড় পদক্ষেপ।

২০১৯ সালে প্রকাশিত জিপিটি-২ মডেলটি চ্যাটজিপিটি-এর অগ্রগতিতে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। তবে অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকে চ্যাটজিপিটি  বর্তমানে নানা রকম উদ্বেগের এর সৃষ্টি করছে। ওপেনএআই শুরুতে জিপিটি প্রাথমিকভাবে রিলিজ করলেও পরে এটি সম্পূর্ণ ফিচার দিয়ে প্রকাশ করে । জিপিটি-২ এর ১.৫ বিলিয়ন প্যারামিটার সহ, ভাষা তৈরির ক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। ডায়ালগ সিস্টেমের জন্য জিপিটি-২ কথোপকথনমূলক এ আই এর কাজ করছে। নভেম্বর ২০১৯-এ ওপেন এ আই-এর চ্যাটজিপিটি-এর রিলিজ এ আই-চালিত চ্যাটবটগুলিতে একটি মাইলফলক।

তবে এটি প্রায়শই ভুল বা অর্থহীন উত্তর তৈরি করে থাকে। তাই ওপেন এআই ‘ফাইন-টিউনিং’ এবং ‘রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ে’র মাধ্যমে চ্যাটজিপিটি-এর কর্মক্ষমতা এবং নিরাপত্তা উন্নত করার চেষ্টা করছে। এই কৌশলগুলি চ্যাটজিপিটিকে কাস্টম ডেটাসেট এবং ক্ষতিকারক বা পক্ষপাতদুষ্ট কন্টেন্ট তৈরির সাথে সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করার অনুমতি দেয়। ওপেনএআই গবেষণা সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করতে এবং চ্যাটজিপিটি -এর সক্ষমতা আরো উন্নত করতে প্রতিযোগিতাও শুরু করে দিয়েছে। বর্তমানে ওপেনএআই এর সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন গবেষকদের সহযোগিতা চ্যাটজিপিটিকে পরিমার্জিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।  

২০২০ সালের জুনে ওপেন এ আই চ্যাটজিপিটি-৩ উন্মোচন করেছে। এই মডেলটির তৃতীয় সংস্করণে ১৭৫ বিলিয়ন প্যারামিটার রয়েছে। এই সংস্করণটি অভূতপূর্ব ক্ষমতার সাথে মানুষের মতো কথা বুঝতে এবং সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে সক্ষম। জিপিটি-৩ প্রায় প্রতিটি দিক থেকে আগের সংস্করণগুলিকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি গ্রাহক সহায়তা, কন্টেন্ট তৈরি, ভাষা অনুবাদ এমনকি সৃজনশীল লেখাতেও কাজ করছে। কোম্পানি এবং ডেভেলপাররা তাদের  অভিজ্ঞতা আরো স্বতন্ত্র উপায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে তাদের প্ল্যাটফর্মে জিপিটি-৩ এর সাহায্য নিচ্ছে। চ্যাটজিপিটি এর সর্বশেষ সংস্করণটিকে বলা হয় জিপিটি-৪। এটি একটি সুপার স্মার্ট এআই আপগ্রেডেড সংস্করণ। এই মডেল কমান্ড করা কাজগুলি দ্রুত করতে পারে এমনকি ভয়েস ব্যবহার করে আপনার সাথে কথাও বলতে পারে।

এখন কোড ইন্টারপ্রেটারের মাধ্যমে টেক্সট, ছবি, ভিডিও, শব্দ এবং কম্পিউটার কোডের মতো বিভিন্ন ধরনের তথ্য বোঝা এবং তৈরি করা যায়। এটি জিপিটি-৪ নামক এআই মডেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এবং এটি সঠিক ফলাফল বুঝতে এবং প্রদানেও সক্ষম। ইন্টারনেট ইউজাররা এখন এই নতুন টুল সম্পর্কে খুব উত্তেজিত এবং এটি সবার কাছে খুব জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে। যদিও এটি একটি শক্তিশালী টুল, তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং সবকিছু করতে পারে না ।

চ্যাটজিপিটি-৫ এর একটি চিত্র, যা চ্যাটজিপিটি মডেলের সাম্প্রতিকতম সংস্করণের উন্নয়ন এবং বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরে।

চ্যাটজিপিটি-৫: নতুন বৈশিষ্ট্য এবং উন্নত সক্ষমতার এক পর্যালোচনা। | ছবি: সংগৃহীত।

ইতিমধ্যে চ্যাটজিপিটির পরবর্তী সংস্করণ, জিপিটি-৫ সম্পর্কে কথা হচ্ছে। যে সংস্থাটি জিপিট-৪, ওপেনএআই তৈরি করেছে। এমনকি তারা জিপিটি-৫-এর জন্য একটি নাম নিবন্ধন করেছে। কিন্তু ওপেনএআই-এর প্রধান বলেছেন যে, তারা এখনও জিপিটি-৫ নিয়ে কাজ শুরু করেনি। তারা পরবর্তী সংস্করণে যাওয়ার আগে জিপিটি-৪ নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করতে চায়।

চ্যাটজিপিটির এই সময়ের সাথে সাথে আপডেটেড ভার্সনগুলি জনপ্রিয়তা পাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন নৈতিক সমস্যা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে ওপেনএআই এর নির্মাতারা জিপিটির এই নৈতিকতা নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে তা সমাধানের কাজ করছে। চ্যাটজিপিটি ব্যাপকভাবে অ্যাক্সেসযোগ্য করার জন্য, ওপেনএআই ২০২১ সালে চ্যাটজিপিটি “এপিআই” প্রকাশ করেছে যা ডেভেলপারদেরকে অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে একীভূত করার সুযোগ দেয়। এটি চ্যাটজিপিটি-এর ভাষা ক্ষমতার উদ্ভাবন এবং গণতান্ত্রিক অ্যাক্সেসকে উৎসাহিত করেছে। বিশ্বব্যাপী গবেষকরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে এআই-এর সম্ভাবনাকে প্রসারিত করে নতুন অ্যাপ্লিকেশন অন্বেষণ করছেন। ভবিষ্যতে আরও বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন এবং প্রসঙ্গ-সচেতন কথোপকথনমূলক এআই-এর সংস্করণ এর সম্ভাবনা রয়েছে।

চ্যাটজিপিটি এর একটি চিত্র, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভাষা প্রক্রিয়াকরণ এবং মানব-মেশিন সংলাপের উদাহরণ দেখানো হয়েছে।

চ্যাটজিপিটি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভাষা প্রক্রিয়াকরণের উদাহরণ। | ছবি: সংগৃহীত।

চ্যাটজিপিটি একটি কম্পিউটার সাধারণ প্রোগ্রাম হিসাবে শুরু হলেও সময়ের সাথে সাথে এটি আরও স্মার্ট হয়ে উঠেছে। চ্যাটজিপিটি দেখায় যে কম্পিউটারগুলো কী করতে পারে এবং কীভাবে তারা ভবিষ্যতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। এই এআই ভাষার মডেল, বর্তমান বিশ্বে অনেক উপায়ে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিছু ভাল এবং কিছু খারাপ। চ্যাটজিপিটি প্রকাশ শুধুমাত্র এআই এর উন্নয়নই নয় আমাদের দৈনন্দিন ও কর্মজীবন রূপান্তরেও উৎসাহিত করেছে।

তাই এই এআই বিপ্লবের অংশ হতে, আপনাকে অবশ্যই শিখতে হবে কিভাবে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হয়।

“তথ্যসূত্র”

ঘুরে আসুন টাকার জাদুঘর থেকে

Previous article

কীভাবে শুরু হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা?

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *