Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার |
বাংলাদেশের ই-কর্মাস খাতে ইভ্যালি একটি পরিচিত নাম। কয়েকশো শতাংশ ক্যাশব্যাক, অর্ধেক দামে পণ্য ক্রয়ের সুবিধাসহ নানা কারণে ইভ্যালি সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের পরিচয় করিয়েছিল অনলাইন স্ক্যামের সাথে। মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে কিভাবে ইভ্যালি হয়ে উঠেছিলো দেশের সবচেয়ে বড় ই-কোম্পানি এবং কিভাবে এর পতন ঘটেছিলো আজ তা বিস্তারিতভাবে জানবো।
ইভ্যালির যাত্রা শুরু
সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ রাসেল ২০১৬ সালে ‘কিডজ ডায়াপার’ ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার শুরু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ব্র্যান্ডটি বাজারে বেশ সুনাম অর্জন করে। এই সাফল্যের পর তিনি একটি ই-কমার্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইভ্যালি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে। ইভ্যালি যখন যাত্রা শুরু করে, তখন মোবাইল যোগাযোগে 3G প্রযুক্তির আবির্ভাবের কারণে বাংলাদেশী গ্রাহকরা অনলাইন কেনাকাটায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলো। শুরুতে গ্রাহক হিসেবে নিবন্ধন করলে ইভ্যালি বিনামূল্যের উপহার এবং কয়েকশো শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের সুবিধা দিতো। এই কারণে মানুষের কাছে ইভ্যালি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। মোটরসাইকেল, ইলেকট্রনিক্স এবং নিত্যপণ্যের উপর অবিশ্বাস্য ছাড় কেবল গ্রাহকদের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, বরং তার সাথে যুক্ত হওয়া ব্র্যান্ড এবং দোকানের সংখ্যাও বৃদ্ধি করেছে।
ইভ্যালির উত্থান
২০১৯ এর শুরুতে ইভ্যালি বিভিন্ন বড় অফার এবং প্রচারাভিযান নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তারা অনলাইন এবং অফলাইনে প্রচুর পরিমাণে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে। ইভ্যালির সিইও মোঃ রাসেল থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ইভ্যালির ফেসবুক গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৪৫,০০০ ছাড়িয়ে যায়। একই বছরের আগস্টে ইভালি স্মার্টফোন অ্যাপ প্রকাশ করলে মাত্র দুই মাসে ৫০,০০০ বারের বেশি ডাউনলোড হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে, ইভ্যালির গ্রস মার্চেন্ডাইজ ভ্যালু (GMV) ছিল প্রায় ৬০ কোটি টাকা। শুধু ২০১৯ সালে, গড়ে ১৫,০০০ ব্যবহারকারী প্রতিদিন ইভ্যালির ওয়েবসাইট পরিদর্শন করেছেন। ইভ্যালি-এর লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল বাজারের সমস্ত পণ্যের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ “Everything Store” থাকা। এই লক্ষ্যে কোম্পানিটি ইফুড, ইখাতা,ইবাজার এর মতো বেশ কিছু ওয়েবসাইট বাজারে নিয়ে আসে।
২০২০ সালের জুনে ইফুড চালু করার সাথে সাথে সিক্রেট রেসিপি, হাক্কা ঢাকা, বিবিকিউ বাংলাদেশ, নর্থ এন্ড কফি রোস্টার, চিলোক্স সহ বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ ইফুডের অংশীদার হিসাবে যুক্ত হয়। ইভালি ক্লাউড-ভিত্তিক ডিজিটাল ফুড কোর্ট ক্লুডিওর সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলো। ফলস্বরুপ ইভ্যালি গ্রাহকরা তাদের ক্যাশব্যাক ব্যালেন্স ব্যবহার করে ইফুডের মাধ্যমে খাবার অর্ডার করার সুবিধা পায়।
ইভ্যালির পুনঃআবর্তন
২০২০ সালের আগস্টে ইভ্যালির ব্যবসায়িক মডেল সম্পর্কে একটি মিডিয়া রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইভ্যালি এবং এর প্রতিষ্ঠাতাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। কোনো কর্তৃপক্ষ ইভালির ব্যবসা বন্ধ না করায় গ্রাহক এবং বিক্রেতারা সর্তক হওয়ার পরিবর্তে আরো বেশি ইভ্যালির প্রতি ঝুঁকে যান। জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান বাটা, অ্যাপেক্স, যমুনা গ্রুপ, স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স প্রস্তুতকারক, কোকা-কোলা সকলেই ইভ্যালির সাথে যুক্ত হন। ব্র্যান্ডের তালিকায় এমন কিছু নাম রয়েছে যারা ইভ্যালির কাছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে। হাজার হাজার ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের মামলা সত্ত্বেও সঠিক সময়ে কোনো ব্যবস্থা সরকার না নেওয়ায় ইভ্যালি দ্বিতীয় পর্বে এত গ্রাহক এবং ব্যবসায়ীকে জড়িত করতে পেরেছিলো।
ইভ্যালি এবং পঞ্জি মডেল
ইভ্যালি যে মডেলে ব্যবসা পরিচালনা করছিলো তাকে পঞ্জি মডেল বা পঞ্জি স্কিম বলে। বিশ্লেষকদের মতে , ইভ্যালির ব্যবসায়িক মডেলের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন কোন মডেল বিশ্বে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলছেন, ‘ইভ্যালি পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করছিলো। এ মডেলে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আর গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে কিছু মানুষকে ছাড়, পুরষ্কার বা লভ্যাংশ দিয়ে মানুষের লোভ বা আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রাখা হয়। এখানে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিনিয়োগ তেমন থাকে না’।
ইভ্যালি এভাবেই ব্যবসা করছিলো। পঞ্জি স্কিম কোনো সাস্টেইনেবল বা টেকসই মডেল না। পঞ্জি স্কিমে যারা ব্যবসা করে, তাদের লক্ষ্য থাকে মানুষের টাকায় ব্যবসা করে অল্প সময়ে কিছু টাকা বানিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া বা অন্যভাবে মার্কেট থেকে টাকা তুলে চলে যাওয়া।
ইভ্যালির পতন
২০২১ সালে জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের মধ্য দিয়ে ইভ্যালি পতনের মুখোমুখি হয়েছিল। চেক জালিয়াতি এবং অন্যান্য জালিয়াতি কার্যক্রম সহ বিভিন্ন অপরাধে মোহাম্মদ রাসেল, তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ৩৫০ টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। রাসেল ও শামীমাকে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে শামীমাকে ২০২২ সালের এপ্রিলে জামিন দেওয়া হয় এবং রাসেলকে ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ সালে মুক্তি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের ই-কর্মাস খাতে ইভ্যালি একটি বড় ধাক্কা। অনেক গ্রাহক এবং বিক্রেতার কোটি টাকা ইভ্যালি আত্মসাত করেছে। গ্রাহকের আস্থায় এক ধরণের সংকট যে দেখা দিয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যবসায়ীদের যেমন নিয়মের মধ্যে ব্যবসা করতে হবে, তেমনি সরকারকে সব সময়ই নজরদারি বহাল রাখতে হবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য।
Comments