Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তায়্যিবা |
পৃথিবীর সব চাইতে জনবহুল দেশ ভারত। সংখ্যার হিসাবে দেশটির জনগণ প্রায় ১৪০ কোটিরও বেশি। বিশ্বের অন্যতম বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও, সম্প্রতি বিভিন্ন সমীক্ষায় গুজব ছড়ানোর দেশ হিসেবে এক নম্বরে উঠে এসেছে ভারতের নাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ইন্টারনেটের বিকাশ এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা নিয়ে স্বল্পজ্ঞানই এর পিছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে।
অত্যাধিক ইন্টারনেট উপস্থিতি
জরিপ বলছে, ভারতে বর্তমানে প্রায় ৮৩ কোটি সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে, সংখ্যাটা মোটেও ছোট নয়। যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এবং ইউটিউব হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম। দেশটিতে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪৮ কোটিরও বেশি, যা পুরো বিশ্বে সর্বোচ্চ।
বিদেশী গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে-এর করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বে গড়ে প্রায় ৫৭% মানুষ ফেক নিউজ বা ভুয়া খবরের সম্মুখীন হন, যেখানে এক ভারতেই এই সংখ্যাটা ৬৪%। বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় ভুয়া তথ্য ২১৪% বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার একটি বড় অংশ ভারত থেকে ছড়িয়েছিল। এর মধ্যে ছিল স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন বানোয়াট ও বিকৃত তথ্য যেমনঃ গোমূত্র পান করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করতে সাহায্য করে, গরুর গোবর গায়ে মাখার ফলে রোগব্যাধি দূর হয়। যদিও পরবর্তীতে এসব ধারণার কোন বৈজ্ঞানিক সত্যতা পাওয়া যায় নি।
সাশ্রয়ী স্মার্টফোন এবং কম খরচে ইন্টারনেট হাতের নাগালে পাওয়ায় ভারতীয়দের অনলাইন কার্যক্রম বেড়েছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা যাচাই বা খণ্ডন করার আগেই লক্ষাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
ডিজিটাল সাক্ষরতার হার কম
ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি হলেও, ডিজিটাল সাক্ষরতার হার তুলনামূলকভাবে কম। অনেকেই অনলাইনে পাওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করার মতো দক্ষতা রাখেন না। এই প্রতিবেদনে পাওয়া হয়েছে, প্রায় ৪৯% ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তাদের প্রধান সংবাদ উৎস হিসেবে ব্যবহার করেন, যেখানে তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করার জন্য কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা নেই।
অনলাইনে সরব উপস্থিতি থাকলেও কোন তথ্য সঠিক আর কোনটা মিথ্যা হতে পারে তা অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই বোঝেন না, তাই আত্মীয়-স্বজন বা কাছের কারো থেকে পাওয়া মেসেজকেই বিশ্বাস করেন। ফলে গুজব ও ছড়ায় দ্রুত।
ভারতের স্কুল অফ ইনফরমেশনের সহযোগী অধ্যাপক, জয়জিৎ পাল যিনি ভারতে রাজনীতিবিদদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রচারের প্রভাব নিয়ে কাজ করেন।
জয়জিৎ বলেন, “অনলাইনে বিপজ্জনক বক্তব্য ও প্রচারণার ক্ষেত্রে মূলত তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ কাজ করে: তথ্যের জটিলতা, বিশ্বাসযোগ্যতার পরিধি এবং এর ব্যাপক বিস্তার।
ভারতে রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং গণমাধ্যমের প্রতি অবিশ্বাস এতটাই প্রবল যে কিছু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী খুব সহজেই এমন তথ্য বিশ্বাস করতে রাজি হয়ে যায়, যা তাদের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে থাকা গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যায়। ফলে, ভুয়া তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি থাকে।“
রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গুজবই ছড়ায় বেশি
ভারতে ভুয়া সংবাদের ধরণের কথা বললে মূলত দুটি ধরণই খুঁজে পাওয়া যায়, একটি হলো রাজনৈতিক খবর, অপরটি ধর্মবিষয়ক।
১. রাজনৈতিক ভুয়া খবর
ভারতে ভুয়া সংবাদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক বিভ্রান্তিমূলক তথ্য নিয়ে গঠিত। এই ধরনের মিথ্যা তথ্য সাধারণত নির্বাচনের সময় জনগণের মতামত প্রভাবিত করতে বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ছোট করতে ব্যবহৃত হয়। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৫ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় ডিজিটাল প্রচারণার মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে। বিশেষ করে, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রাজনৈতিক অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা নির্বাচনী সময়ে ভুল তথ্যের প্রবাহকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।
২. ধর্মীয় ভুয়া খবর
ধর্মীয় বিভ্রান্তিমূলক তথ্যগুলো মূলত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলমানদের লক্ষ্য করে প্রচার করা হয় এবং বেশিরভাগ সময় এটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ছড়ানো হয়ে থাকে। ভারতে হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান এই সমস্যাকে দিন দিন আরও ঘনীভূত করছে। ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অপপ্রচার মানুষের ব্যক্তিজীবনে সহিংসতা ও বৈষম্যের সৃষ্টি করছে।
উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারির সময় মুসলিম সম্প্রদায়কে দোষারোপ করে মিথ্যা প্রচারের কথা বলা যায়। এই ধরনের ভুয়া তথ্য শুধু সামাজিক বিভাজনই বাড়ায় না, বরং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতাকে উস্কে দেয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুয়া তথ্যের কেন্দ্র হিসেবে ভারতের অবস্থান মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং কম ডিজিটাল সাক্ষরতার কারণে তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশটিতে ছড়ানো মিথ্যা খবর ও গুজব দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ও মহামারির মতো বিষয়গুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই ধরণের অপপ্রচার কেবল সামাজিক বিভাজনই সৃষ্টি করছে না, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়, যেমন নির্বাচনে, ভুয়া তথ্য ব্যাপকভাবে জনমত প্রভাবিত করতে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিভ্রান্তি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নাগরিকদের ডিজিটাল শিক্ষা বাড়াতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য শক্তিশালী তথ্য যাচাই ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
Comments