Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার |
নাইকি জুতার সাথে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। আমাদের প্রিয় অ্যাথলেটদের পায়ে কিংবা বিজ্ঞাপনে আমরা তাঁদেরকে নাইকি জুতা পড়তে দেখেছি। নাইকি পায়ে মাইকেল জর্ডানের সেই বিজ্ঞাপনের কথা এখনো আমাদের চোখে ভাসে। আমরা কি জানি কোম্পানিটির আইডিয়া এসেছিলো একটি একাডেমিক কোর্সের কাজ থেকে? কি অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? হ্যা, আসলেই কোম্পানিটির আইডিয়া এসেছিলো ফিল নাইটের একাডেমিক কাজ থেকে। আর আজ কোম্পানিটি পরিণত হয়েছে বিলিয়ন ডলারে। চলুন আজকে বিস্তারিত জেনে নেই কিভাবে নাইকি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কিভাবে এটি সারাবিশ্বে এতো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
শুরুর গল্প
নাইকির যাত্রা শুরুর গল্পটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং। নাইকির প্রতিষ্ঠাতা ফিল নাইট ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগন থেকে তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ বিজনেসে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে পড়ার সময় তিনি একটি প্রজেক্ট পেপার লিখেন, যেখানে তিনি বলেন জাপান থেকে জুতা আমদানি করে আমেরিকাতে বিক্রি করলে সে ব্যবসা লাভবান হবে। যুক্তি হিসেবে তিনি সেসময় আমেরিকার মার্কেটে জাপানিজ ক্যামেরার সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। পুরো আইডিয়াটা তিনি কোর্সের একটা প্রজেক্টের জন্য তৈরি করলেও পরবর্তীতে তিনি এটা নিয়ে আগানো শুরু করেন।
গ্র্যাজুয়েশন শেষে নাইট বিশ্বভ্রমণে বের হন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি জাপানে যান। জাপানের ওনিৎসুকা টাইগার ব্র্যান্ডের সাথে জুতা আমদানির চুক্তি করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী স্যাম্পল হাতে পেতে তার লেগে গিয়েছিলো প্রায় এক বছর! প্রথম যখন তিনি ১২ জোড়া জুতার স্যাম্পল হাতে পান, সাথে সাথেই তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার কোচ বিল বোওয়ারম্যানের কাছে। যিনি জুতোর কোয়ালিটিতে ইমপ্রেসড হয়ে তা শুধু কিনেই নেননি, সাথে সাথেই তার ব্যবসার ৪৯% শেয়ার ক্রয় করেন।
অবশেষে জানুয়ারি ২৫, ১৯৬৪ সালে নাইট ও বোয়ারম্যানের হাত ধরে ব্লু রিবন স্পোর্টসের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে ব্লু রিবন স্পোর্টস এর বিক্রি চলতো নাইটের গাড়ির ট্রাংক থেকে। তিনি প্যাসিফিক নর্থ ওয়েস্ট এর রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রির কাজ চালাতেন। অন্যদিকে বোয়ারম্যান ছিলেন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রচুর রিসার্চ করতেন এবং খুঁজে বের করতেন যে, কোন ধরনের ডিজাইন এথলেটের পারফরমেন্সের উপর ভালো প্রভাব ফেলবে। ১৯৬৬ সালে ব্লু রিবন স্পোর্টস ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা মনিকায় তারা প্রথম রিটেল ষ্টোর খুলেন।
‘নাইকি’ নাম যেভাবে এলো
১৯৭১ এর শুরুর দিকে ব্লু রিবন স্পোর্টস থেকে নাইকি হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। এর পিছনে ছিলো এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। ডেলিভারিতে দেরী করা, অন্য কোম্পানির সাথে চুক্তি করা এবং বোওয়ারম্যানের ডিজাইন অনুযায়ী জুতা সাপ্লাই না দেয়া সহ নানা কারণে জাপানের ওনিৎসুকা টাইগার ব্র্যান্ডের সাথে তারা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। নাইট তখন নতুন করে সব শুরু করতে চাচ্ছিলেন। কারণ, ব্লু রিবন স্পোর্টস ছিল শুধু একটি আমদানিকারক কোম্পানি, যারা জাপান থেকে এনে জুতা বিক্রি করতো। আর তাই কোম্পানির প্রথম কর্মচারী জেস জনসনের আইডিয়া অনুসারে এর নাম রাখা হয় ‘নাইকি’।
গ্রিক মিথোলজি অনুসারে ‘নাইকি’ হচ্ছেন বিজয়ের দেবী। তিনি যুদ্ধ, খেলাধুলা ও শিল্পে জয় লাভের জন্য বিখ্যাত। কোম্পানির ভিশনের সাথে মিলে যাওয়ায় এই দেবীর নামেই ব্র্যান্ডের নাম রাখা হয় নাইকি। কোম্পানির জনপ্রিয় লোগোটি ডিজাইন করেছিলেন পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্রাফিক ডিজাইনের ছাত্র ক্যারোলিন ডেভিডসন। হালকা ঢেউ খেলানো এই লোগো কোম্পানির নতুন নাম এবং ভিশনের সাথে মিলে যায়। নিজেদের ডিজাইন করা ওয়াফল ট্রেনার শু দিয়েই নাইকির পথচলা শুরু হয়।
নাইকির প্রথম জুতা
নাইকির প্রথম জুতাটির নাম ছিলো ‘মুন জুতা’ এবং এটি বোওয়ারম্যানের ওয়াফেল আয়রনে তৈরি করা হয়েছিল। এই জুতার পেছনে বেশ মজাদার একটি গল্প রয়েছে। ওয়াফেলের একমাত্র নকশাটি সফল হয়েছিল যখন বিল বোওয়ারম্যান সকালের নাস্তা করছিলেন এবং ভাবছিলেন যে খেলাধুলার সময় তার ওয়াফেলের খাঁজগুলি অতিরিক্ত ট্র্যাকশনের জন্য কাজ করবে কিনা। অবশেষে এই জুতা মার্কেটে আসে এবংএর গ্রিপিং ও কর্মক্ষমতা-চালিত ডিজাইনের কারণে প্রায় তাৎক্ষণিক সাফল্য পায়। এই জুতা সোথেবি’স-এ প্রায় $ ৪৫০,০০০ ডলারে বিক্রি হয়েছিল।
তাদের মূল সাফল্য আসে ‘অ্যাজটেক’ নামক একটি ডিজাইনের সাথে। তবে অ্যাডিডাসের অনুরূপ নামযুক্ত স্নিকার থাকার কারণে তাদেরকে নামটি পরিবর্তন করতে হয়েছিল। পরবর্তীতে জুতাটি নাইকি কর্টেজ নামে জনপ্রিয় হয়। মেক্সিকো গেমসে আত্মপ্রকাশ করার পরে কর্টেজ একটি দুর্দান্ত সাফল্যে পরিণত হয়। উন্নত ডিজাইন এবং প্রযুক্তির কারণে কর্টেজ নাইকিকে স্নিকার জায়ান্ট হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলো। যদিও কর্টেজ জুতা নিয়ে বেশ কাহিনী রয়েছে। কারণ নাইট এবং বোওয়ারম্যান নাইকি নামে তাদের নিজস্ব সংস্করণ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এটি মূলত ওনিটসুকা কোং দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল। যখন ওনিটসুকা নাইকির কর্টেজ মডেল বিক্রি করার বিষয়ে জানতে পেরেছিল, তখন সমস্যাটি বৃদ্ধি পায় এবং শেষ পর্যন্ত ঘটনা আদালতের যায়। আদালতে মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছিলো এবং বিচারক রায় দিয়েছিলেন যে উভয় ব্র্যান্ডই তাদের নামে কর্টেজের নিজস্ব পুনরাবৃত্তি বিক্রি করতে পারে।
জর্ডান যুগ
নাইকির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চলছিলো। এমন সময় ১৯৮৪ সালে কোম্পানিটি মাইকেল জর্ডান নামক ২১ বছর বয়সী তরুণ বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। জর্ডান প্রথম খেলা শুরু করেন শিকাগো বুলস থেকে। তার খেলার স্টাইল, কারিশমা এবং মেধা খুব দ্রুতই সারা বিশ্বে ভক্তদের নজর কেড়ে নেয়। আর এই জনপ্রিয়তা ধরতে পেরে নাইকি তার সাথে কোলাবোরেশনে যাওয়ার অফার করে। মাইকেল জর্ডান নাইকির সাথে মিলে বাজারে আনেন তার নিজস্ব লাইন এয়ার জর্ডান। এই সিরিজের জুতা মূলত অ্যাথলেটিক ফুটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিকে সারা জীবনের জন্য বদলে দিয়েছিলো।
পিটার মুরের ডিজাইন করা এয়ার জর্ডান তার বোল্ড কালার, হাই টপ সিলোয়েট এবং নাইকির আইকনিক উইংস এর সাথে বাস্কেটবল লোগো দিয়ে ভক্তদের মন কেড়ে নেয়। অত্যাধুনিক টেকনোলজিতে করা এয়ার জর্ডান পায়ে মাইকেল জর্ডানের পারফরম্যান্স সারা বিশ্বে বাস্কেটবল ফ্যানদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। বিশ্বজুড়ে এয়ার জর্ডান শুধু জুতা নয় বরং স্টাইলে পরিণত হয়। বর্তমানে সবমিলিয়ে ৩৫টি এডিশনের এয়ার জর্ডান জুতা নাইকি রিলিজ করেছে।
নাইকি যেভাবে সফলতার শীর্ষে পৌঁছালো
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করার পেছনে নাইট এবং বোওয়ারম্যানের অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যাবসায় রয়েছে। তারা যেসকল উপায় অবলম্বন করে সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন চলুন সে সম্পর্কে জেনে নেই।
জাস্ট ডু ইট
‘জাস্ট ডু ইট’ স্লোগানের জন্য নাইকি বেশ জনপ্রিয়। ব্যতিক্রমী এই স্লোগান নাইকির ব্যান্ডভ্যালু বৃদ্ধি করেছে। নাইকির যাত্রা শুরুর প্রতিটি গল্পের মতোই স্লোগানের কাহিনীও বেশ মজাদার। মূলত ১৯৮৭ সাল থেকে মার্কেটিংয়ে স্লোগান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফাস্টফুড কোম্পানি থেকে শুরু করে ফেডেক্সের মতো কোম্পানিও ব্যবহার করছিলো স্লোগান। সে সময় উইডেন কেনেডি অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির সহপ্রতিষ্ঠাতা ড্যান উইডেন দায়িত্ব পেয়েছিলেন নাইকির জন্য একটা স্ট্রং স্লোগান তৈরি করার। ড্যানি এই স্লোগানের আইডিয়া পান বেশ অন্যরকম সোর্স থেকে। মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা একজন খুনীর বলে যাওয়া শেষ কিছু শব্দ তার মাথায় বাজে। মারা যাওয়ার আগে খুনী শেষবার বলেছিলেন “লেটস ডু ইট।” এই লেটস ডু ইট কে সামান্য পরিবর্তন করে নাইকির স্লোগান করা হয় জাস্ট ডু ইট। সিম্পল অথচ শক্তিশালী “জাস্ট ডু ইট” ১৯৮৮ সালে যখন প্রথমবারের মতো টেলিভিশন কমার্শিয়ালে এই স্লোগান প্রচারিত হয়, তখন তার প্রভাব সকলেই বুঝতে পারে। মাত্র তিন শব্দের এই ছোট্ট স্লোগান দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়, মানুষ ফিটনেস ও সেলফ ইমপ্রুভমেন্টের দিকেও আগ্রহী হয়ে পড়ে। এই স্লোগান জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তৈরি করে একটা লাইফ স্টাইল, একটা ফ্যাশন এবং নিজের লক্ষ্য ও স্বপ্নকে পূরণ করার পিছনে হাল না ছাড়ার এক অনুপ্রেরণা বাণী।
নাইকি শুধু পণ্য বিক্রি করে না, গল্পও বলে
নাইকি নিশ্চিত করে যে তার প্রতিটি পণ্যই যেনো গল্প বলতে পারে। তাদের ব্র্যান্ডিং এবং প্রচারণার মাধ্যমে, কোম্পানি তাদের পণ্য পরিধানকারী ক্রীড়াবিদদের সম্পর্কে গল্প বলে থাকে। নাইকি কাস্টমারের চাহিদা বুঝে তাদের পণ্য তৈরি করে। নাইকির বিজ্ঞাপনে প্রায়ই পেশাদার ক্রীড়াবিদ এবং সাধারণ ব্যক্তিদের মিশ্রণ দেখা যায়, যা তাদের গল্পগুলোকে দর্শকদের সাথে অনেক বেশি সম্পর্কিত করে তোলে। লেব্রন জেমস বা অজানা কোনো হাইস্কুল রানার যে চরিত্র হোক না কেনো, নাইকি তাদের গল্প বলে। নাইকি তার দর্শকদের সাথে গভীর সংযোগ তৈরি করতে আবেগকে কাজে লাগায়। তারা সবসময় তাদের বিজ্ঞাপন প্রতিকূলতার উপর বিজয়, ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং মানবিক চেতনার মতো থিমগুলোতে ফোকাস করে তৈরি করে। আর তাই এই ব্র্যান্ডের প্রতি মানুষের এতো আনুগত্য এবং বিশ্বাস গড়ে উঠেছে।
মার্কেটিং
নাইকির সফলতার পেছনে মার্কেটিং বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুরু থেকেই, নাইট এবং বোওয়ারম্যান বিভিন্ন ক্রীড়াবিদদের দিয়ে মার্কেটিং করিয়ে নাইকির প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি করেন। মাইকেল জর্ডান, রোনালদিনহো, টাইগার উডস, লেব্রন জেমস, সেরেনা উইলিয়ামস এর মতো জনপ্রিয় অ্যাথলেটদের সাথে কোলাবরেশন নাইকিকে পপ সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিতে এবং এর অংশ হতে সক্ষম করেছিল এবং এই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
শেষ কথা
নাইকির প্রতিষ্ঠাতা ফিল নাইট স্বপ্ন দেখতেন তিনি একজন অ্যাথলেট হবেন। তবে তাঁর এই স্বপ্ন সত্যি না হওয়ায় তিনি এমন কিছু করতে চেয়েছিলেন যা তাকে তাঁর অপূর্ণ স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দ দিবে। সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শুরু করা একটি কোম্পানি আজ পরিণত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অ্যাথলেটিক জুতা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে। গত ২০২২ অর্থবছরে কোম্পানির রাজস্ব ছিলো ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
Comments