গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তাহসিন
প্রায়শই বলা হয়, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তবে সকলেই তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন না, তার জন্য দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী হতে হয়। ধীরুভাই আম্বানি এমনি এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাফল্যের নাম, যিনি শূন্য থেকে শুরু করে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানি ভারতের ব্যবসায়িক জগতের একজন যুগান্তকারী ব্যাক্তিত্ব। তাঁর জীবনের সংগ্রাম, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, এবং ঝুঁকি নেওয়ার অদম্য সাহস তাঁকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আজকের গল্পটি কেবলমাত্র এক ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ীর সাফল্যগাঁথা নয়, বরং এক সাধারণ ব্যক্তির অসাধারণ হয়ে উঠার গল্প।
শুরুর দিনগুলো
ধীরুভাই আম্বানির জন্ম ১৯৩২ সালে, গুজরাটের এক ছোট গ্রামে। তাঁর বাবা হিরাচাঁদ গোবরধনভাই আম্বানি একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন এবং তার মা জামনাবেন আম্বানি ছিলেন একজন গৃহিণী। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তাই খুব অল্প বয়সেই জীবনযুদ্ধে নামেন। নিজের মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ইয়েমেনে পাড়ি জমান। সেখানে একজন কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য। সেই সময় তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৩০০ টাকা।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সূচনা
১৯৫৮ সালে ধীরুভাই ভারতে ফিরে আসার পর শুরু করেন নিজের ব্যবসা। সেই সময়ে তার হাতে ছিল মাত্র ৫০০ টাকা, , কিন্তু ছিল অদম্য মনোবল এবং স্বপ্ন। তিনি মুম্বাইয়ে তার পরিবারসহ একটি এককক্ষের বাসায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন কাপড় ও মশলা ব্যবসা শুরু করেন। তার নাম ব্যবসায়িক জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছিল ৮ বছর।
পরবর্তীতে ১৯৬০ এর দশকে ধীরুভাই তার ভাই চম্পকলাল দামানির সাথে “রিলায়েন্স কমার্শিয়াল কর্পোরেশন” প্রতিষ্ঠা করেন, যা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের পূর্বসূরি ছিল। শুরুতে তিনি বস্ত্র উৎপাদনে হাত দেন এবং ক্রমেই রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজকে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম কোম্পানিতে পরিণত করেন।
সফলতার সূত্রাপাত এবং বৈশ্বিক খ্যাতি অর্জন
ধীরুভাই আম্বানির অন্যতম বড় গুণ ছিল তাঁর নেতৃত্বের ক্ষমতা। তিনি কেবল একজন সফল ব্যবসায়ীই ছিলেন না, বরং এক অসাধারণ নেতা। তাঁর এই অসাধারণ গুণের কারণে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ধীরে ধীরে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম কর্পোরেট গ্রুপ হয়ে ওঠে। তিনি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন, এবং কার্যকরী নেতৃত্বের মাধ্যমে কোম্পানিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।
ধীরুভাই আম্বানির নেতৃত্বে রিলায়েন্স গ্রুপ আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত হয় । প্রবেশ করে পেট্রোকেমিক্যাল, পরিশোধন ও টেলিযোগাযোগ খাতে। সাধারণ মানুষের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত করে তিনি প্রথমবারের মতো ভারতে স্টক মার্কেটকে জনপ্রিয় করেন। তার এই পদক্ষেপগুলো তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে, এবং রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে।
তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে সঠিক নেতৃত্ব ও মনোভাব নিয়ে যেকোনো স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব।১৯৮৬ সালে ধীরুভাই আম্বানি প্রথমবারের মতো বড় স্ট্রোক করেন। তার ডান হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর তিনি তার ব্যবসা তার দুই ছেলের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০২ সালের ২৪শে জুন তিনি দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করেন এবং তিনি কোমায় চলে যান । ৬ই জুলাই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে, মুকেশ আম্বানি এবং অনিল আম্বানি, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্ব নেন। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ আজও ভারতের অন্যতম বৃহত্তম এবং সফল কোম্পানি হিসেবে সমাদৃত। ধীরুভাইয়ের তৈরি করা মডেল এবং কৌশল আজও ব্যবসায়িক জগতে এক অনন্য উদাহরণ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে শূন্য থেকে শুরু করে বিশাল এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যায়। আজও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ একটি বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
Comments