কোম্পানি ফরেনসিকস

“হাতিল” বাংলাদেশি ফার্নিচার শিল্পের আইকন

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া

হাতিল বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ফার্নিচার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, যা ১৯৮৯ সালে সেলিম এইচ. রহমান প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে দরজা তৈরির ব্যবসা হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরে ফার্নিচার ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের দিকে অগ্রসর হয়। বছরের পর বছর ধরে হাতিল উদ্ভাবনী ডিজাইন, গুণগতমানের পণ্য এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশে ৭০টি শোরুম, দুটি অত্যাধুনিক কারখানা, ই-কমার্স ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ এবং দেশের প্রথম ভার্চুয়াল শোরুম পরিচালনা করছে।

হাতিলের উত্থান

হাতিলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে, যখন সেলিম এইচ. রহমানের বাবা হাবিবুর রহমান “এইচ.এ. টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড” প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলাদেশের প্রথম কাঠ সিজনিং প্লান্ট। এক গ্রাহকের অনুরোধে সেলিম এইচ. রহমান তার বাবার কারখানায় দরজা তৈরি শুরু করেন এবং ১৯৮৯ সালে হাতিল ডোর্স প্রতিষ্ঠা করেন। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার পর তিনি ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে ফার্নিচার তৈরিতে আগ্রহী হন। ১৯৯৩ সালে, কোম্পানিটি ঢাকার কুড়িলে একটি বিশেষায়িত কারখানা স্থাপন করে।

২০০২ সালে, হাতিল ল্যাকার ফিনিশ প্রযুক্তি প্রবর্তন করে, যা পণ্যের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব বাড়ায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে শ্যামপুর ও ফরাশগঞ্জে অতিরিক্ত কারখানা স্থাপন করা হয়। ২০০৮ সালে, হাতিল সাভারের জিরানিতে একটি আধুনিক কারখানায় সব কার্যক্রম একীভূত করে এবং গুণগতমান নিশ্চিত করতে জাপানি কাইজেন দর্শন প্রয়োগ করে।

বৈচিত্র্য ও উদ্ভাবন

হাতিলের পণ্য তালিকার মধ্যে বাড়ি ও অফিসের জন্য আসবাবপত্র, দরজা এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইন অন্তর্ভুক্ত। প্রতিষ্ঠানটি উন্নত উৎপাদন কৌশল, রোবোটিক্স এবং সিএনসি মেশিন ব্যবহার করে পণ্যের গুণগতমান ও দক্ষতা নিশ্চিত করে। পরিবেশ রক্ষার জন্য হাতিল ঐতিহ্যবাহী সেগুন কাঠের পরিবর্তে এফএসসি-সার্টিফাইড ওক এবং বিচ কাঠ ব্যবহার করে।

হাতিলের বৈচিত্র্যময় ও উদ্ভাবনী ডিজাইনের ফার্নিচার।

বৈচিত্র্য ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে হাতিল বাংলাদেশের ফার্নিচার শিল্পে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। | ছবি সংগৃহীত।

ক্রেতার অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য, ২০১৬ সালে হাতিল দেশের প্রথম ভার্চুয়াল স্টোর চালু করে, যেখানে ক্রেতারা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি হেডসেট বা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে পণ্য ঘুরে দেখতে পারেন। এই উদ্ভাবন, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সাথে মিলিত হয়ে, হাতিলকে প্রযুক্তি-নির্ভর ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

বিশ্বজুড়ে হাতিলের প্রসার

হাতিল ১৮টিরও বেশি দেশে ফার্নিচার রপ্তানি করে, যার মধ্যে রয়েছে ভারত, নেপাল, ভুটান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্য। ২০১৩ সালে এটি প্রথম বিদেশি আউটলেট অস্ট্রেলিয়ায় চালু করে এবং পরে কানাডা, ভারত এবং আশেপাশের দেশগুলোতে প্রসারিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি বছরে ১৫ লক্ষ মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি করে এবং দেশীয় বাজারে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে।

সাফল্যের কারণ

হাতিলের সাফল্যের মূল কারণ হলো উদ্ভাবন, গুণগতমান এবং গ্রাহক সন্তুষ্টির প্রতি প্রতিশ্রুতি। এটি ক্রেতাদের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য বৈচিত্র্যময় পণ্য সরবরাহ করে। উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি বিশ্বমানের ফার্নিচার তৈরি করে।

প্রযুক্তি গ্রহণে হাতিল সর্বদা অগ্রগামী। প্রতিষ্ঠানটি এআর এবং ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে আধুনিক যুগের গ্রাহকদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। এছাড়া, সঠিক ব্র্যান্ডিং ও গ্রাহকসেবার মাধ্যমে এটি ভোক্তাদের কাছে বিশ্বস্ত নাম হয়ে উঠেছে।

মূল ব্যবসায়িক কার্যক্রম

১. গুণমানের প্রতি প্রতিশ্রুতি

হাতিল উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি, যেমন- সিএনসি মেশিন এবং স্বয়ংক্রিয় ফিনিশিং সিস্টেম ব্যবহার করে টেকসই এবং নির্ভুল ফার্নিচার তৈরি করে।

২. পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম

হাতিল পরিবেশগত দায়বদ্ধতায় অঙ্গীকারবদ্ধ। এটি কিলন-ড্রাইড কাঠ এবং পুনর্ব্যবহৃত বোর্ডের মতো টেকসই কাঁচামাল ব্যবহার করে এবং উপাদন প্রক্রিয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও শক্তি সাশ্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

হাতিলের পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমের প্রতিফলন।

পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমের মাধ্যমে হাতিল টেকসই উন্নয়নের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। | ছবি সংগৃহীত।

৩. বহুমুখী পণ্য সংগ্রহ

হাতিলের পণ্য পরিসরে রয়েছে- বাসা ও অফিসের ফার্নিচার, দরজা এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইন পরিষেবা। শহুরে গ্রাহকদের জন্য স্থান সাশ্রয়ী এবং মডুলার ডিজাইনগুলো বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

৪. বৈশ্বিক সম্প্রসারণ

হাতিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশে সফলভাবে তার স্থান দখল করেছে। বৈশ্বিক শোরুমগুলো বাংলাদেশের কারিগরির গৌরব আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরছে।

৫. ডিজিটাল উদ্ভাবনের গ্রহণযোগ্যতা

হাতিল প্রযুক্তি-নির্ভর কেনাকাটার অভিজ্ঞতা প্রদান করে। তাদের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং ভিআর শোরুম গ্রাহকদের কেনার আগে পণ্যের স্থানিক কল্পনা করার সুযোগ দেয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

হাতিল আইওটি-সক্ষম ( ইন্টারনেট অব থিংগস) প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করে স্মার্ট ফার্নিচার চালু করার পরিকল্পনা করেছে, যা আধুনিক জীবনের চাহিদা মেটাবে।  এছাড়াও নতুন শোরুম খোলা এবং উদীয়মান বাজারগুলোতে প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানটি তার আন্তর্জাতিক উপস্থিতি শক্তিশালী করতে চায়। হাতিল কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ এবং পুনব্যবহৃত উপকরণ দিয়ে তৈরি ফার্নিচার লাইন চালু করার পরিকল্পনা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ চালিয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

হাতিলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ধারণা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মাধ্যমে হাতিল ফার্নিচার শিল্পে উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে এগিয়ে চলছে। | ছবি সংগৃহীত।

একটি ছোট দরজা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বৈশ্বিক ফার্নিচার ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া হাতিলের যাত্রা উদ্ভাবন, স্থায়িত্ব ও গুণগতমানের প্রতি প্রতিশ্রুতির একটি উদাহরণ। এটি বাংলাদেশের ফার্নিচার শিল্পকে রূপান্তরিত করেছে এবং বৈশ্বিক বাজারে একটি প্রতিষ্ঠিত নাম হয়ে উঠেছে। নকশা এবং পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকার জন্য হাতিল বহু পুরস্কার অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণের সক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটিকে দেশে এবং বিদেশে একটি বিশ্বস্ত নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

“তথ্যসূত্র”

দেশেই আপনি যেভাবে ওয়াফেল বিজনেস শুরু করবেন

Previous article

এটিএস-বান্ধব জীবনবৃত্তান্ত তৈরির সহজ গাইডলাইন

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *