কোম্পানি ফরেনসিকস

ইস্পাহানি টি গ্রুপ: বাংলাদেশের চা শিল্পে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া

ইস্পাহানি গ্রুপ বাংলাদেশের চা শিল্পে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাম, যা দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক কনজিউমার ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সুপ্রতিষ্ঠিত পারিবারিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যা ১৮২০ সালে ইরানের ইস্পাহান থেকে মুম্বাইয়ে হাজি মোহাম্মদ হাশিমের হাত ধরে শুরু হয়। কালের পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠানটি মুম্বাই থেকে কলকাতা, তারপর ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু স্থাপন করে।

প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস

ইস্পাহানি পরিবারের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সূচনা হয় ১৮২০ সালে, ইরানের ইস্পাহাম শহরে। হাজি মোহাম্মদ হাশিমের মৃত্যুর পর তার পৌত্র মির্জা মেহেদি ইস্পাহানি ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর মুম্বাই থেকে মাদ্রাজে স্থানান্তর করেন। তিনি ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মিশরসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান এবং ঢাকায় একটি কার্যালয় স্থাপন করেন।

পরবর্তীতে, মির্জা মোহাম্মদ ইস্পাহানি কলকাতায় ‘এমএম ইস্পাহানি অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়, যা আজও প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় হিসেবে বিদ্যমান।

বাংলাদেশে চা শিল্পের বিবর্তন

বাংলাদেশে চা উৎপাদন ১৮৫৪ সালে শুরু হয়, সিলেটে মালনীচেরা চা বাগান প্রতিষ্ঠার সাথে। সময়ের সাথে সাথে এই খাত উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা ১৭২টিরও বেশি চা বাগান এবং ১১৬,০০০ হেক্টরেরও বেশি জমি জুড়ে রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য হিসাবে চায়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা সত্ত্বেও, সীমিত বিনিয়োগ এবং কম উৎপাদনশীলতার কারণে শিল্পটি বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যার ফলে দেশীয় চাহিদা অবশেষে স্থানীয় উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যায়। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশ তার বর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে চা আমদানিকারক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

ইস্পাহানি টি গ্রুপ এবং বাংলাদেশের চা শিল্পের বিবর্তন।

চা শিল্পে ইস্পাহানির অবদান

ইস্পাহানি গ্রুপ চা শিল্পে তাদের অগ্রণী ভূমিকার জন্য পরিচিত। ব্রিটিশ ভারতে চা চাষ শুরুর পর ইস্পাহানি পরিবার চা শিল্পে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশে চা শিল্পে শীর্ষস্থানীয় অবস্থান অর্জন করে। বর্তমানে, ইস্পাহানি দেশের শীর্ষস্থানীয় চা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা স্থানীয় ও বহুজাতিক প্রতিযোগিতার মধ্যেও তাদের অবস্থান সুসংহত করেছে।

তাদের চারটি চা বাগান রয়েছে, মির্জাপুর, গাজীপুর, জেরিন (মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায়) এবং নেপচুন (চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায়)। এই বাগানগুলো উৎকৃষ্ট মানের চা উৎপাদনে সুপরিচিত। ২০ শতকের মাঝামাঝি ইস্পাহানি গ্রুপ চা শিল্পে অনুপ্রবেশ করে। ব্যবসার শুরতেই বাজারে আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে ইস্পাহানি গ্রুপ।

১৯৬০-এর দশকে, ইস্পাহানির মালিকানাধীন ছিল বাংলাদেশে চারটি চা বাগান,এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত মির্জাপুর চা বাগান। তবে, বাজারে এর আধিপত্য শুধুমাত্র মালিকানা থেকেই আসেনি বরং ব্র্যান্ডিং, বিতরণ এবং গ্রাহকের পছন্দ সম্পর্কে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এসেছে। বাংলাদেশি ভোক্তাদের পছন্দ বিবেচনায় এনে ইস্পাহানি তার ফ্ল্যাগশিপ মির্জাপুর ব্র্যান্ডের অধীনে উচ্চ-মানের প্যাকেজড চা চালু করে। ল্যামিনেটেড পাউচ এবং ডাবল-চেম্বার টি ব্যাগ সহ প্যাকেজিংয়ে উদ্ভাবনগুলির সুযোগ নিয়ে, ব্র্যান্ডটি একটি অনন্য চা পানের অভিজ্ঞতা প্রদান করে। ১৯৯০-এর দশকে, ইস্পাহানি নিজেদের মার্কেট লিডার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে লিপটন তাজা এবং সিলন গোল্ডের মতো স্থানীয় এবং বহুজাতিক প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে গিয়েছে।

উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ

২০২৩-২৪ মৌসুমে, বাংলাদেশে ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। ইস্পাহানি গ্রুপের চারটি বাগান চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক নিলামে ৪৪ লাখ ২৫ হাজার ৮০৩ দশমিক ৭০ কেজি চা বিক্রি করেছে। তাদের চা উচ্চ দামে বিক্রি হয়েছে, যা গুণমানের প্রমাণ।

ইস্পাহানি টি গ্রুপের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া।

প্রতিযোগিতা ও সাফল্য

বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও, ইস্পাহানি তাদের গুণমান ও সাশ্রয়ী মূল্যের মাধ্যমে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। তাদের চা পণ্য উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সমানভাবে জনপ্রিয়। ইস্পাহানি গ্রুপের ব্যবসা কেবল চা শিল্পেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা টেক্সটাইল, পাট, আবাসন, শিপিং, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন খাতে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। প্রায় ২০,০০০ কর্মী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সামাজিক অবদান

ইস্পাহানি গ্রুপ চা শিল্পের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায়ও অবদান রাখছে। ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালের মাধ্যমে তারা সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদান করছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ইস্পাহানি গ্রুপ চা উৎপাদন ও বিনিয়োগে ক্রমাগত সম্প্রসারণ করছে। তারা গুণমান বজায় রেখে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে দেশের অন্যতম এফএমসিজি ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইস্পাহানি টি গ্রুপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

নেতৃত্ব ও উত্তরাধিকার

২০১৭ সালে মির্জা আলী বেহেরুজ ইস্পাহানির মৃত্যুর পর তার ভাই মির্জা সালমান ইস্পাহানি গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে, ইস্পাহানি পরিবারের সদস্যরা লন্ডনে স্থায়ী হলেও বাংলাদেশের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানের দক্ষ কর্মী ও ব্যবস্থাপকদের ওপর নির্ভর করছেন।

ইস্পাহানি গ্রুপের দীর্ঘ পথচলা তাদের উদ্ভাবনীতা, দৃঢ়প্রত্যয় এবং গুণমানের প্রতিফলন। গ্রাহক সন্তুষ্টি এবং ক্রমাগত উন্নতির অঙ্গীকার রেখে ইস্পাহানি একটি অনন্য ব্র্যান্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে তারা সঠিক পথেই রয়েছে, যা দেশ ও বিশ্ববাজারে তাদের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।

“তথ্যসূত্র”

যেভাবে ডেটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে সফল উদ্যোক্তা হবেন

Previous article

কীভাবে দেশীয় স্কয়ার হয়ে উঠল বিলিয়ন ডলার কোম্পানি?

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *