Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার |
বাংলাদেশের ফাস্ট ফুড সেক্টরে যে দেশীয় ব্রান্ড মাইলফলক স্থাপন করেছে তার নাম হলো খানা’স। ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করা এই রেস্তোরাঁ এখন নিজেকে একটি ব্র্যান্ডে রূপান্তর করতে পেরেছে। সুলভমূল্যে আন্তর্জাতিক মানের খাবার বিক্রির জন্য খুব সহজেই খানা’স জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আজকে আমরা খানা’স প্রতিষ্ঠার গল্প এবং কেনো খানা’স এতো জনপ্রিয় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
খানা’স -এর যাত্রা
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ খানা’স -এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন এহসান আহমেদ, রেদওয়ানুর রহমান এবং শাহিন মাহমুদ। মূলত বসুন্ধরা গ্রুপে কাজ করার সুবাধে তারা তিনজন বেশ ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন। তিনজনই ভোজন রসিক হওয়ায় অফিস টাইমের পরে তারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নতুন নতুন খাবার উপভোগ করতেন। খাবারের প্রতি ভালোবাসা থেকে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার বিক্রি করার উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ২০১২ সালে মিরপুর ১০-এ ‘আন্দে খানা’ নামে একটি ফুড কার্ট শুরু করে। এই ফুড কার্টের ট্যাগলাইন ছিল -“একটি অর্থনীতির সতেজতা”।
প্রথম দিকে তারা আন্দে খানা ফুড কার্টে শুধু ডিম দিয়ে সব খাবার তৈরি করতেন। অফিস টাইম শেষে তারা মিরপুর ১০-এ খাবার বিক্রি করতেন। ‘আন্দে খানা’ স্বল্প সময়ের মধ্যেই গ্রাহকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরে আন্দেখানার তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজি তারা ২.৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। সেসময় দেশে ফুড কার্ট ব্যবসা চালানোর কোনো নির্দেশিকা না থাকায় তারা প্রায়ই আইনি সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান তারা খুঁজতে থাকেন। ঠিক সেইসময় তারা জানতে পারে যে, বসুন্ধরার কাছে ঐতিহ্যবাহী বাজার স্থাপনের জন্য একটি ‘রিয়েল এস্টেট’ প্রস্তুত করা হচ্ছে। যে জায়গাটি ৩০০ ফুট নামে পরিচিত ।
এই তিন উদ্যোক্তা সেই ‘রিয়েল এস্টেট’-এর মালিকের কাছে গিয়েছিলেন। তারা তাকে একটি উন্মুক্ত ফুড কোর্টের ধারণা দিয়েছিলেন, যেখানে একাধিক রেস্তোরাঁ থাকবে এবং গ্রাহকেরা একই জায়গায় বসে নানা ধরনের খাবার উপভোগ করতে পারবে। রিয়েল এস্টেটের মালিক তাদের এই ধারণা পছন্দ করেন এবং ‘কাজী ফুড আইল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘কাজী ফুড আইল্যান্ড’ ফুড কোর্টের শুরুর দিকের রেস্তোরাঁ ছিলো “আন্দে খানা”। পরে তারা তাদের রেস্তোরাঁকে খানা’স নামে পুনঃব্র্যান্ডিং করেছিলো। আর এভাবেই বাংলাদেশে খানা’স-এর যাত্রা শুরু হয়।
খানা’স যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে
খানা’স জনপ্রিয় হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো তাদের খাবারের মূল্য। বসুন্ধরার আশেপাশের এলাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে, তারা তাদের খাবারের মূল্য নির্ধারণ করে। আর এই কারণে তারা খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তাদের মেন্যুতে সাব স্যান্ডউইচ, কোল্ড কফি, ওয়েজেসের মতো নানা ধরনের ফাস্ট ফুড আইটেম যুক্ত হয়। অন্যদের তুলনায় সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন খাবার পরিবেশন করায় ভোক্তারা খানা’স-এর খাবার পছন্দ করতে শুরু করে। ভোক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে খানা’স ওয়েজেস এবং কোল্ড কফি।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠাতা এহসান আহমেদ তাদের দ্রুত জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে খাবারের স্বাদ এবং বাজেট-বান্ধব মূল্যের কথা বলেন। ৩০০ ফিটের ছোট আউটলেট থেকে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই রেস্তোরাঁ ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। খানা’স নিজেদের কারখানায় মসলা তৈরি করে এবং এটি তাদের খাবারের অন্যতম প্রধান উপাদান। প্যাকেটজাত মসলার উপর নির্ভরশীল না হওয়ায় তাদের খাবারের স্বাদ অন্যদের থেকে বেশ আলাদা হয়ে থাকে। এছাড়াও, প্রথম থেকেই প্যাকেজিংয়ের জন্য কার্ডবোর্ড ব্যবহার করায়, রেস্তোরাঁয় বসে খাবার উপভোগ করার পাশাপাশি সহজেই কেউ খাবার বাইরে খেতে পারে। এইসব কারণে খানা’স অল্প সময়ে মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বর্তমান খানা’স এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা
যাত্রার শুরু থেকেই খানা’স মেনুতে নতুন খাবার যোগ করার পরিবর্তে, খাবারের মান বজায় রাখার দিকে বেশি নজর দিয়েছে। একইসাথে খানা’স প্রথম থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জনতার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। আর এই কারণে খানা’স অন্যদের থেকে আলাদা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বর্তমানে শুধু ঢাকায় খানা’সের ১৪ টি আউটলেট রয়েছে। এ বিষয়ে সহ-প্রতিষ্ঠাতা শাহিন মাহমুদ জানান, “সারাদেশে ভোজন রসিকদের চাহিদা মেটাতে খান’স সব বিভাগের ২০টি শহরে আউটলেট খোলার কাজ করছি”।
খানা’স নিজেদেরকে একটি বহুজাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আর তাই ২০২৫ সালে খানা’স লন্ডন এবং ব্যাংককে নিজেদের আউটলেট খোলার কাজ করছে বলে জানান সহ-প্রতিষ্ঠাতা শাহিন। খানা’সের আউটলেট সাধারণত দুই ধরনের হয়, ফ্ল্যাগশিপ এবং ক্লাসিক। সাধারণত ২,০০০ বর্গফুটের চেয়ে বড় আউটলেটগুলোকে ফ্ল্যাগশিপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর ১,০০০ বর্গফুটের চেয়ে বড় আউটলেটগুলোকে ক্লাসিক আউটলেট বলা হয়। খানা’স দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রমবর্ধমান খাতগুলোর মধ্যে ফাস্ট ফুড সেক্টর অন্যতম। গত এক দশকে অনেক বিদেশি রেস্তোরাঁর ফুড চেইন যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনি গত এক দশকে অনেক ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করা স্থানীয় রেস্তোরাঁও মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর মধ্যে খানা’স অন্যতম। মাত্র একটি ফুড কার্ট থেকে যাত্রা শুরু করে, খানা’স বর্তমানে বাংলাদেশের ফাস্ট ফুড এবং রেস্তোরাঁ সেক্টরে একটি হাইপড ব্র্যান্ড।
Comments