Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া |
আপনি হয়ত নিজস্ব একটি ব্যবসা দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। কিন্তু ব্যবসার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন আপনার হাতে নেই যা দিয়ে আপনি ব্যবসাটি শুরু করতে পারবেন। আর এ ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্যই বর্তমানে উদ্যোক্তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনিয়োগকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।
আপনাকে নিজের কোনো স্টার্টআপ শুরু করতে হলে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিতে হবে অর্থ–সংস্থানে। ব্যবসার মূলধন অথবা ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার জন্য হলেও অর্থ–সংস্থান প্রয়োজন। এছাড়াও আপনি যখন কোনো দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবসা শুরু করতে চাবেন, ব্যক্তিগত মূলধন আপনাকে খুব বেশি সাহায্য করতে পারবেনা। একজন বিনিয়োগকারির অর্থ বিনিয়োগের প্রাথমিক লক্ষ্যই হল বিনিয়োগের উপর সর্বাধিক রিটার্ন করা।
বিনিয়োগকারী কারা?
বিনিয়োগকারী হল এমন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যিনি বা যারা আর্থিক রিটার্ন পাওয়ার আশায় কোনো ব্যবসার প্রসারের জন্য মূলধন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। সাধারণত একজন বিনিয়োগকারীর বিভিন্ন খাতে অর্থ বিনিয়োগ করার কিছু লক্ষ্য থাকে, যেমন– লভ্যাংশ বেশি পাবার আশায়, ব্যাংক ঋণের সুবিধা থাকায়, মালিকানা পাবার আশায়, আয় ও ঝুঁকিতে ভিন্নতা থাকায় ইত্যাদি।
চলুন জেনে নেই কিছু প্রতিষ্ঠিত উৎস সম্পর্কে যা আপনাকে ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারি খুঁজতে সাহায্য করবে।
১। বুটস্ট্র্যাপিং বা আত্ম–অর্থসংস্থান
স্টার্টআপ শুরু করতে হলে প্রথমেই যে কারো মাথায় আসবে ব্যবসার মূলধন বা পুঁজির কথা। যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে কেউ তার স্টার্টআপটি শুরু করতে পারবে। নিজের জমানো টাকা, আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের থেকে ব্যবসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করাই হলো বুটস্ট্র্যাপিং বা আত্ম–অর্থসংস্থান। তবে আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদি বা বড় কোনো ব্যবসা দাঁড় করাতে চান, এই বুটস্ট্র্যাপিং আপনার একমাত্র ভরসাস্থল হবেনা।
সম্প্রতি বাংলাদেশে হেড গিয়ার(টুপি’র ব্র্যাণ্ড)–এর তিন উদ্যোক্তা ইকরামুল হক, মো. ইমরান হোসেন ও ইফতেখার আহমেদ মাত্র ১২ হাজার টাকা দিয়ে টুপি বিক্রির বিজিনেস শুরু করে বর্তমানে দেশের ভেতরে অনলাইনে মাসে তাদের ব্র্যাণ্ডে’র সাত হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার টুপি বিক্রি করে থাকে। এমনকি দেশের বাইরেও নিজেদের ব্র্যান্ডকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন এই তিন উদ্যোক্তা।
২। ক্রাউড ফান্ডিং
কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগে অর্থায়ন করার মাধ্যমে বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করাই হলো ক্রাউড ফান্ডিং। এই প্ল্যাটফর্মটি প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ধীরে ধীরে পরিচিতি পেয়েছে। ক্রাউড ফান্ডিং প্ল্যাটফর্মটিতে, একজন উদ্যোক্তা স্টার্টআপ নিয়ে নিজের সকল ভাবনা বা পরিকল্পনা নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট উপস্থাপন করেন।
বিনিয়োগকারীদের মাঝে যদি কেউ উপস্থাপিত বিষয়বস্তু বা বিজনেস নিয়ে আগ্রহী হোন তবে তিনি সেটি বাস্তবায়ন করতে উদ্যোক্তাকে পর্যাপ্ত অর্থ প্রদান করবেন। পর্যাপ্ত মূলধন নিয়ে তখন উদ্যোক্তা নতুন একটি ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। বাংলাদেশে অপরাজয় ডট ওআরজি (oporajoy.org) নামে একটি ক্রাউড ফান্ডিংয়ের প্ল্যাটফর্ম আছে।
ক্রাউড ফান্ডিংয়ের উদাহরণ- ২০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ২০১৪ সালে ফেসবুক যে অকুলাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছিলো সেটিও কিন্তু ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
৩। এঞ্জেল ইনভেস্টরস
এঞ্জেল ইনভেস্টর হলেন সেই সকল বিনিয়োগকারী, যারা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা শুরু এবং পরিসর বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় মূলধন প্রদান করেন এবং অর্থ প্রদানের সাথে সাথে উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শও প্রদান করে থাকেন, এমনকি এই বিনিয়োগের কারণে তারা কোম্পানিটির শেয়ারও অর্জন করতে পারেন।
এঞ্জেল ইনভেস্টররা এককভাবে থাকতে পারেন, অথবা একটা দল হয়েও বিনিয়োগ করতে পারেন। মূলত তরুন উদ্যোক্তাদের স্টার্টআপ এর বিভিন্ন আইডিয়াগুলোতে তারা বিনিয়োগ করতে চান। তাদের নিকট যে আইডিয়াগুলো উপস্থাপন করা হয় সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে উপযুক্ত এবং জুতসই উদ্যোগটি তারা সূক্ষ্মভাবে বিচার–বিশ্লেষণ করেন এবং বিনিয়োগ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এঞ্জেল ইনভেস্টরসদের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো– আমাজন ডটকম, স্টারবাকস ও অ্যাপল। শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো খুব ছোট আকারের থাকলেও পরবর্তীতে এই বিজনেসগুলো এঞ্জেল ইনভেস্টরসদের মাধ্যমেই সম্প্রসারিত হয়েছিলো। এছাড়াও বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ এঞ্জেলসের উদ্বোধন হয়েছে। উদ্যোক্তা কিংবা বিনিয়োগকারীরা ফান্ডের জন্য আবেদন করতে পারবেন এই লিংকের মাধ্যমে: www.bdangels।
৪। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল
বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক লোন দেওয়ার পূর্বে বিভিন্ন ফ্যাক্টরে যাচাই–বাছাই করে থাকে যা একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার পক্ষে গেলেও, একদম শূন্য থেকে শুরু করা একজন উদ্যোক্তার পক্ষে সকল ফ্যাক্টর মেনে লোন নেওয়া সম্ভব হয়না। এ ক্ষেত্রে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত।
যেখানে ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ একটি নতুন ব্যবসায়িক আইডিয়া, সেখানে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি গ্রহণ করতে আগ্রহী থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১১টির বেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে অর্থায়নের কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো– হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপ ডট ইনক, কিং ডিজিটাল এন্টারটেইনমেন্ট, ক্যানডি ক্রাশ সাগা গেইম ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমেই নিজেদের ব্যবসায় অর্থসংস্থান করেছে।
৫। বিজনেস ইনকিউবেটর
বিজনেস ইনকিউবেটর হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যেখানে নতুন এবং সম্ভাবনাময় ব্যবসায়িক ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করা হয়। ধরুন এটি এক ধরনের পুষ্টির মাধ্যম, যেখানে একটি নতুন ব্যবসা তার প্রাথমিক পর্যায়ে বেড়ে উঠতে সব ধরনের সহযোগিতা পায়।
বাংলাদেশেও অনেক বিজনেস ইনকিউবেটর রয়েছে, যেমন- চুয়েটের শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর। এই ইনকিউবেটরটি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নতুন উদ্যোক্তাদেরকে সহায়তা করে। এছাড়াও বাংলাদেশে ব্যবসা সহায়ক প্ল্যাটফর্ম “ওয়াইওয়াই গোষ্ঠী” এখন ইনকিউবেশনে খুব ভালোভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা পুঁজির ব্যবস্থা করার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, কাজের জায়গা এবং ব্যবসায় উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সহায়তা যেমন মার্কেটিং ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিচ্ছে।
৬। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থ
নিয়মিতই নতুন নতুন আইডিয়া উপস্থাপনের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এ ধরনের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মূলত অনন্য এবং অসাধারণ উদ্যোগগুলোকে বের করে আনার চেষ্টা করা হয়। প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ আইডিয়াগুলোর জন্য যে ‘প্রাইজমানি’ দেওয়া হয় তা একজন উদ্যোক্তার জন্য বেশ উপকারি হতে পারে। এ ধরনের পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থ, ব্যবসা শুরু করতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খুব বড় পরিসরে এই ধরনের আয়োজন হয়। যেমন- মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় স্টার্টআপ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ২০১৭ সালে ১১টি স্টার্টআপকে ৩৭ হাজার ৫০০ ডলারের অর্থায়ন করা হয়। এর মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচিতি এবং কাজের ব্যাপ্তি অনেক বেড়ে গিয়েছে।
৭। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান
একজন উদ্যোক্তাকে নিজের ব্যবসাটি যে খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটির জন্য কোন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে সেটি বুঝতে হবে। প্রতিষ্ঠিত কিংবা নতুন উভয় ধরনের ব্যবসার জন্যই বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাংকে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা আছে। এসএমই ফাউন্ডেশন বর্তমানে ৩টি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কিছু ঋণ সুবিধা হলো:
- আইডিএলসি স্টার্টআপ লোন: সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫ বছরে পরিশোধযোগ্য।
- কর্মসংস্থান ব্যাংক: বিনা জামানতে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ।
- মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক: সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত স্মল বিজনেস লোন। ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো জামানতের প্রয়োজন নেই।
- আইএফআইসি প্রান্ত নারী (উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর লোন): তৃণমূল পর্যায়ের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ।
- ইকুইটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ডঃ বাংলাদেশ ব্যাংক: সফটওয়্যার, ফুড প্রসেসিং, অ্যাগ্রো–বেসড ইন্ডাস্ট্রির জন্য।
- আইডিএলসি উদ্ভাবন লোন: সর্বনিম্ন ৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা পর্যন্ত। বেসিস সদস্যদের জন্য বিশেষ সুবিধা।
৮। ক্ষুদ্রঋণ
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এনজিও, যেমন– গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা ইত্যাদি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে থাকে। তারা মূলত তৃণমূল পর্যায়ে এমন উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করে, যাঁদের জন্য ক্ষুদ্রঋণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৯। স্টার্টআপের জন্য সরকারি প্রকল্প
বিভিন্ন সময় সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চলমান সমস্যা সমাধানের উপায় খোঁজে। তা ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্টার্টআপের জন্য মূলধন দেওয়ার সুযোগও পাওয়া যায়। স্টার্টআপের অর্থায়নের জন্যে এ ধরনের সরকারি প্রকল্প প্রোগ্রামগুলো বেশ কার্যকর।
Comments