Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আনিকা তায়্যিবা |
আজ থেকে দশ পনেরো বছর আগেও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য মানেই ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য। কিচছুটা দামি কিনতে চাইলে জাপানী বা জার্মান যন্ত্র, কমের মধ্যে দেখতে গেলে চায়নার কম টেকসই পণ্য। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেশীয় বাজারে ওয়ালটন ব্র্যান্ড মান এবং নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের অন্যতম পরিচিত ইলেকট্রনিক্স নির্মাতা। রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার থেকে শুরু করে অন্যান্য গৃহস্থালি পণ্য সহ বিস্তৃত পণ্যসমাহার নিয়ে ওয়ালটন এখন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পরিচিত নাম। বছর পরিক্রমায় এটি বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স বাজারের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছে এবং বিশ্ববাজারেও তাদের পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
প্রথম দিকের ইতিহাস
ওয়ালটন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এস এম নজরুল ইসলাম, ১৯২৯ সালে টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন। সৎ ও স্বাধীন মনোভাবাপন্ন এই উদ্যোক্তা ১৯৭৭ সালে পারিবারিক ব্যবসা ত্যাগ করে নিজের উদ্যোগ শুরু করেন। তার ছেলেরা ধীরে ধীরে তার সাথে যুক্ত হন এবং তাদের সাহায্য নিয়েই আজ ওয়ালটন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসার প্রসার ঘটায়। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কোম্পানিটি ইলেকট্রনিক্স শিল্পে প্রবেশ করে এবং ভবিষ্যতের সফলতার ভিত্তি স্থাপন করে।
ওয়ালটনের প্রসার ও উন্নতি
২০০৭ সালে ওয়ালটন তাদের নিজস্ব উৎপাদন কারখানা স্থাপন করে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কার্যক্রমের সূচনা করে। প্রথম দিকে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার এবং মোটরবাইক উৎপাদন করে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এক বছরের মধ্যেই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। ২০১০ সালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ওয়ালটনের ডিজিটাল ডিভাইস বাজারে প্রবেশ করে। ২০১১ সালের মধ্যে ওয়ালটন বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদন শুরু করে এবং বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পে নিজেকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।
অর্জন ও বাজারে অবস্থান
নিরবচ্ছিন্ন উদ্ভাবন ও মানের উপর মনোযোগ দিয়ে ওয়ালটন শুধু ক্রেতাদের মনই নয় , অর্জন করেছে অনেক পুরস্কার। ২০১১ সালে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে পাল্লা দিয়ে ওয়ালটন ‘সেরা ব্র্যান্ড’ পুরস্কার লাভ করে। পরবর্তী কয়েক বছরে ওয়ালটন আরও উন্নত উৎপাদন সুবিধা গড়ে তোলে, রান্নাঘরের সরঞ্জাম যেমন রাইস কুকার, প্রেসার কুকার ইত্যাদির জন্য বিশেষায়িত কারখানা স্থাপন করে এবং ওয়ালটন মাইক্রো-টেক কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৫ সালের মধ্যে ওয়ালটন স্থানীয় বাজারে ৬০% রেফ্রিজারেটর বাজার এবং ৩০% টেলিভিশনের বাজার দখল করে, যেখানে এক সময় বিদেশী দামি ব্র্যান্ডগুলোর জোরদখল ছিল। ওয়ালটনের উৎপাদন পরিমাণও দ্রুত বৃদ্ধি পায়, প্রতি বছর ১৪০ লক্ষ রেফ্রিজারেটর, ১০ লক্ষ টেলিভিশন, ৩ লাখ মোটরবাইক এবং ৩ লাখ এয়ার কন্ডিশনার তৈরি করা হয় ওয়ালটনের কারখানায়।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও টেকসই উৎপাদন
ওয়ালটনের টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয় যা এই দীর্ঘসময়ে অধিক সংখ্যক ক্রেতা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। ২০১৭ সালে ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট কর্তৃক “ফাইভ স্টার এনার্জি রেটিং” অর্জন করে। সেই বছরই ওয়ালটন বাংলাদেশের একমাত্র কম্প্রেসার উৎপাদনকারী কারখানা চালু করে। টেকসই উৎপাদনে অগ্রগামী হওয়ার লক্ষ্যে তারা সিএফসি-মুক্ত গ্যাস ব্যবহার করে এবং তাদের পণ্যের নকশা ও প্যাকেজিংকেও পরিবেশবান্ধব রাখার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত।
বিশ্ববাজারে ওয়ালটনের প্রবেশ
ওয়ালটন বর্তমানে ৪০টিরও বেশি দেশে তাদের পণ্য রপ্তানি করছে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হুন্ডাই ইলেকট্রনিক্সের সাথে চুক্তির মাধ্যমে রেফ্রিজারেটর এবং এয়ার কন্ডিশনারের মতো পণ্য সরবরাহ করছে বিশ্বব্যাপী। রপ্তানি বৃদ্ধিতে তাদের গবেষণা ও উন্নয়ন সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ালটন কর্পোরেশন এবং ভারত, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করে তারা তাদের বৈশ্বিক উপস্থিতি আরও বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট।
ওয়ালটনের ছোট্ট উদ্যোগ থেকে একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের গল্পটি আমাদের অজানা হলেও উদ্ভাবন এবং টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর তাদের দায়বদ্ধতার সাক্ষ্য বহন করে। তাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নীতি এবং মানসম্পন্ন পণ্য দিয়ে ওয়ালটন বাংলাদেশি গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে যুগের পর যুগ ধরে। তাই আজ ওয়ালটন শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও তাদের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
Comments