Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির |
দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি কার্গো শিপমেন্ট চালুর মাধ্যমে। কয়েক দশক ধরে দুই দেশের সম্পর্ক নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেলেও, ২০২৪ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান থেকে একটি কার্গো জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। এই পদক্ষেপটি শুধু বাণিজ্যের জন্য নয়, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
সরাসরি শিপিংয়ের পুনর্জাগরণ
১৯৭১ সালের পর দীর্ঘ সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি কোনো শিপিং যোগাযোগ ছিল না। ৫৩ বছর পর এই যোগাযোগ পুনরায় চালু হওয়া দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও গতিশীল করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রুট চালুর ফলে দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ উভয়ই কমবে। যেখানে আগে ভারত হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পণ্য আনতে সময় ও খরচ বেশি হতো, এখন সরাসরি জাহাজ চলাচলের কারণে ব্যবসায়ীরা আরও সুবিধা পাবেন।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
সরকারি পর্যায়ে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। একজন ব্যবসায়ী জানান, “আমরা পাকিস্তানি পণ্যের ভালো বিকল্প পেয়েছি। তবে, প্রশাসনিক জটিলতা দূর না হলে আমাদের জন্য টিকে থাকা কঠিন হবে।” তাছাড়া, এই রুট ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। তবে মোটা দাগে দেশের ব্যবসায়ীরা যে সুবিধা গুলো পাবেন,
১। পণ্য পরিবহন সহজ হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা কম খরচে তাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবেন।
২। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়িক বাজারেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
৩। পাকিস্তান তাদের টেক্সটাইল, কাগজ, এবং পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য সরবরাহে নতুন বাজার পাবে।
পাকিস্তান থেকে পণ্য সরাসরি আসলেও এই পথ কোন ভাবেই কম নয়। দীর্ঘ ২,৬০০ নটিক্যাল মাইলের শিপিং রুটে পণ্য পরিবহনে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে। রুটের কার্যকারিতা এবং খরচ ব্যবস্থাপনায় এখনও উন্নতির প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেক ব্যবসায়ী।
ভারতের উদ্বেগের কারণ
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে এই সরাসরি শিপিং রুট চালুর ফলে ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে প্রভাব পড়তে পারে। এই ব্যপারে ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অনিল ত্রিবেদী বলেন, “পাকিস্তান-বাংলাদেশের এই সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য কাঠামোতে নতুন দিক নির্দেশ করবে। তবে ভারত যদি তার নিজস্ব পণ্য সরবরাহ চেইন উন্নত না করে, তবে ভারত দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক চাপে পড়বে।”
অন্যদিকে ভারতের কূটনীতিক এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত শ্যাম সরণ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই রুট দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগলিক রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে, এবং এটি ভারতের জন্য সতর্কবার্তা।” একই ভাবে ভারতের অনেক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে এর বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সরাসরি শিপিং রুট উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে, তবে এটি শুধুমাত্র সফল হবে যদি উভয় দেশ তাদের প্রশাসনিক এবং লজিস্টিক সমস্যা সমাধান করতে পারে। বাংলাদেশের বাণিজ্য বিশ্লেষক, ড. নাসিম আহমেদ বলেন, “সরকারি পর্যায়ে সঠিক নীতি প্রণয়ন এবং ব্যবসায়ীদের জন্য সহজতর সুযোগ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে কর্মক্ষমতা বাড়াতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিতে হবে।”
পাকিস্তান-বাংলাদেশ সরাসরি কার্গো শিপমেন্ট দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ও বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্কই নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কও আরও শক্তিশালী হবে। তবে, ভারতের প্রতিক্রিয়া ও এই আঞ্চলের বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করাও এই প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী সফলতার জন্য বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
Comments