Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তাহসিন আয়েশা আক্তার |
প্রতিদিন সকালে দিনের শুরুতে আপনি কোন কাজটি করেন? নিশ্চয়ই হাতের কাছে রাখা মোবাইল ফোনে ফেসবুকে নোটিফিকেশন চেক করেন বা খুঁজে দেখেন হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমেইলে নতুন কোনো ক্ষুদেবার্তা এলো কিনা!
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেট ছাড়া আমরা এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারি না। ইন্টারনেট কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি শিক্ষা, মতপ্রকাশ, এবং বিনোদনের অন্যতম মূল উৎস। আর তাই আধুনিক এই যুগে, ইন্টারনেট সেবা পৃথিবীর অনেক দেশে একটি স্বীকৃত মৌলিক অধিকার।
“ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অফ হিউম্যান রাইটস” (ইউডিএইচআর) এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ইন্টারনেট সেবাকে মানবাধিকার ঘোষণা করে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখানে বলা হয়েছে , “প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের মধ্যে রয়েছে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত ধারণ করার স্বাধীনতা এবং যেকোনো মিডিয়ার মাধ্যমে এবং সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও ধারণা খোঁজা, গ্রহণ এবং প্রদান করার স্বাধীনতা।” মানবাধিকার হিসাবে ইন্টারনেট সেবার স্বীকৃতি সত্ত্বেও, অনেক দেশের সরকার জনগণের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভিন্নমত প্রকাশে বাধা প্রদান করতে ইন্টারনেট শাটডাউন আরোপ করে চলেছে।
বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঘটনা নতুন নয়। এখন পর্যন্ত ২০২৪ সালে ৭৭ টি ইন্টারনেট শাটডাউন হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তার উদ্বেগ এবং তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন কারণে এই শাটডাউনগুলো দেয়া হয়।
গত ১৮ জুলাই, বাংলাদেশ সরকার ১৫০ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। সাবেক আইসিটি মন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ইন্টারনেট বন্ধের জন্য মহাখালীতে অগ্নিসংযোগকে দায়ী করেছেন। কিন্তু ক্লাউডফ্লেয়ার এবং টেলিনরের মতো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এই অজুহাতকে অস্বীকার করেছেন এবং নিশ্চিত করেছেন যে শাটডাউনটি সরকারের আদেশে ঘটেছে। “একসেস নাও” এর মতে, বাংলাদেশ সরকার বা টেলিকম সংস্থাগুলির কোনো যুক্তি ছাড়াই ২০১৮ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টারনেট সেবা বারবার বন্ধ করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা বলতে পারি। সেসময় সরকার দেশব্যাপী মোবাইল ইন্টারনেটে ধীরগতির করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ২০১৯ এবং ২০২৩ সালেও বাংলাদেশে বিক্ষোভ এবং বিরোধী সমাবেশের সময় ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ার একাধিক ঘটনার রিপোর্ট রয়েছে।
যেহেতু, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় দেশের ইন্টারনেট প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরকারী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা যেন দুরুহ হয়ে পড়ে। তাই বিশেষ সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ হয়।
ইন্টারনেট এবং মানবাধিকারঃ
- অনেক দেশ তাদের আইনি কাঠামোতে ইন্টারনেট সেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এস্তোনিয়া ২০০০ সালে সর্বপ্রথম ইন্টারনেট সেবাকে মানবাধিকার হিসাবে ঘোষণা করে এবং ২০১০ সালে ফিনল্যান্ড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট অ্যাক্সেসকে আইনি অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) বিশেষ প্রতিবেদক বলেছেন যে, “ইন্টারনেট থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এবং কোনো অবস্থাতেই তা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না”।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (২) ধারা অনুযায়ী, তথ্যপ্রাপ্তি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। কিন্তু ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মাধ্যমে সরকার নিজেই এসব অধিকার লঙ্ঘন করছে।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট বাক স্বাধীনতা এবং তথ্যের অ্যাক্সেসকে সবচেয়ে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল বলেছে যে,
“বাক-স্বাধীনতার অধিকারের উপর কোনো সীমাবদ্ধতা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট আরোপ করে, বাংলাদেশ সরকার কার্যকরভাবে তার সমগ্র জনগণের জন্য এই অধিকারগুলি লঙ্ঘন করেছে।”
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট শুধু নাগরিকদের মতপ্রকাশকেই রুদ্ধ করছে না, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মৌলিক অধিকারগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট মৌলিক এবং আন্তর্জাতিক উভয় মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এই শাটডাউনগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রায়শই ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়, যার উদ্দেশ্য ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখা। মানবাধিকার সুরক্ষায় এবং ইন্টারনেটে স্বাধীন মতপ্রকাশ রক্ষায় সরকার, সুশীল নাগরিক সমাজকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।
Comments